ভল্টের ১৯ কোটি টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার খবরে বেশ আলোচনায় আসে চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি খাতের ইউনিয়ন ব্যাংক। এর রেশ না কাটতেই আরেকটি অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এবার ভুয়া এফডিআরে (এককালীন স্থায়ী আমানত) ১০ কোটি টাকা ব্যাংকটি থেকে সরিয়ে নিয়েছে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি একাধিক সংস্থার নজরে আসলেও ওই অর্থ ঋণ দেখিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত ইউনিয়ন ব্যাংক!

ঘটনাটি ঘটেছে ইউনিয়ন ব্যাংকের হাটখোলা শাখায়। একটি প্রতিষ্ঠান ভুয়া এফডিআর দেখিয়ে ১০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। কিন্তু ওই এফডিআরের অ্যাকাউন্টে কোনো টাকাই ছিল না। ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টের কাছে অভিযোগ করেন, কোনো প্রকার আইনের তোয়াক্কা না করে বোর্ডের অনুমতি ছাড়া বিনা জামানতে ওই টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এবার ভুয়া এফডিআরে (এককালীন স্থায়ী আমানত) ১০ কোটি টাকা ব্যাংকটি থেকে সরিয়ে নিয়েছে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি একাধিক সংস্থার নজরে আসলেও ওই অর্থ ঋণ দেখিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত ইউনিয়ন ব্যাংক

নিরাপত্তার স্বার্থে পরিচয় গোপন করে ইউনিয়ন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গত বছরের (২০২০ সাল) ২৪ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বিষয়টি জানিয়ে চিঠি পাঠান। দুদক চিঠিটি নথিভুক্ত করে চলতি বছরের (২০২১ সাল) ১১ জানুয়ারি।

চিঠিতে বিষয়টি তদন্ত করে দুর্নীতিগ্রস্তদের আইনের আওতায় আনার অনুরোধ জানানো হয়। তবে, দুদক অভিযোগটি তদন্ত না করে গত ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়ে দেয়।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ইউনিয়ন ব্যাংকের হাটখোলা শাখা থেকে ২০২০ সালের ১৫ জুলাই ভুয়া এফডিআর দেখিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যার হিসাব নম্বর-০০৪৭০৯০০০০০৫৬ এবং সিআইএস নম্বর- ৩০৬৯৩২। হিসাবটি খোলা হয় একই দিন অর্থাৎ ২০২০ সালের ১৫ জুলাই। ১২ শতাংশ মুনাফা রেটে ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেওয়া আছে ২০২১ সালের ১৫ জানুয়ারি।

বর্তমানে শাখাপ্রধান বারবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তাগিদ দিলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো সাড়া দিচ্ছেন না। তিনি শাখাপ্রধানকে জানিয়েছেন, তার সঙ্গে দুদকের বড় কর্মকর্তার ভালো সম্পর্ক। আপনি (শাখাপ্রধান) কোনো চিন্তা করবেন না

ওই প্রতিষ্ঠানটির একটি কারেন্ট অ্যাকাউন্টও আছে। যার নম্বর- ০০৯১০১০০০৭১৭২, কাস্টমার আইডি নং- ৩০৬৯৩২। প্রতিষ্ঠানটি সুকৌশলে টাকাটি নিজের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে না নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বের করে নিয়ে যায়। যার পে-অর্ডার নম্বর- ৩২০৬৮৪৭, তারিখ ১৫ জুলাই ২০২০ ইং। যা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মৌখিক আদেশে দেওয়া হয়।

বর্তমানে শাখাপ্রধান বারবার ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তাগিদ দিলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো সাড়া দিচ্ছেন না। তিনি শাখাপ্রধানকে জানিয়েছেন, তার সঙ্গে দুদকের বড় কর্মকর্তার ভালো সম্পর্ক। আপনি (শাখাপ্রধান) কোনো চিন্তা করবেন না।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘আত্মসাৎকারী ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের নামে ইতোপূর্বে তিস্তা নদীর ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা রয়েছে। মামলাটি এখনও চলমান। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কীভাবে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকের নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীদের দিয়ে কোনোপ্রকার আইনের তোয়াক্কা না করে মর্টগেজ ব্যতীত, বোর্ডের অনুমতি ছাড়া টাকা দিয়ে দিল; যা ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।’ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মৌখিক নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন অধস্তন কর্মকর্তারা—চিঠিতে এমন অভিযোগও উল্লেখ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘আত্মসাৎকারী ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের নাম ইতোপূর্বে তিস্তা নদীর ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা রয়েছে। মামলাটি এখনও চলমান। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কীভাবে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে মর্টগেজ ব্যতীত টাকা দিল

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হলেও ইউনিয়ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারেনি। শুধু বলেছে, ‘অ্যাকাউন্টের বিপরীতে একটি ঋণ তৈরি করা হয়েছে।’ এর বেশি কিছুই জানানো হয়নি।

 ‘উধাও’ হওয়া ১৯ কোটি টাকা এক ভিভিআইপিকে দেওয়া হ‌য়ে‌ছে— বলেন ব্যাংক‌টির ডিএম‌ডি হাসান ইকবাল / ছবি- সংগৃহীত

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে একটি বিস্তর তদন্তের প্রয়োজন। কারণ, টাকাগুলো বিদেশে পাচারের আশঙ্কা রয়েছে। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে চাইলে অদৃশ্য চাপে তা আটকে আছে।

১০ কোটি টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকটির হাটখোলা শাখায় যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু সেখানকার কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনিও ফোন রিসিভ করেননি। গতকাল রোববার (২৬ ডিসেম্বর) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে গুলশানে এমডির কার্যালয়ে সরাসরি গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ব্যস্ততা দেখিয়ে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি। পরে এমডির দফতরের এক কর্মকর্তা মোকাম্মেল হক চৌধুরীর ব্যক্তিগত সচিবের (পিএস) সঙ্গে কথা বলতে বলেন। তিনিও এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।

১০ কোটি টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকটির হাটখোলা শাখায় যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু সেখানকার কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি

এর আগে ১৯ সেপ্টেম্বর ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ১৯ কোটি টাকা ‘উধাও’ হয়ে যায়। বিষয়টি ওই সময় বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। জানা যায়, ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা পরিদর্শনে গিয়ে ভল্টে রক্ষিত টাকার হিসাবে গরমিল দেখতে পান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কাগজপত্রে দেখানো হয় ভল্টে ৩১ কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা সেখানে পান ১২ কোটি টাকা। বাকি ১৯ কোটি টাকার ঘাটতি সম্পর্কে শাখাটির কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তারা পরিদর্শক দলকে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

এত বড় অনিয়মের ঘটনার পরও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

ওই সময় ভল্টের টাকা গরমিলের বিষয়ে ইউনিয়ন ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হাসান ইকবাল গণমাধ্যমে জানান, গত ১৯ সেপ্টেম্বর ব্যাংকিং লেনদেন শেষে সন্ধ্যার পর শাখায় একজন গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহক (ভিআইপি) নগদ টাকা নেওয়ার জন্য আসেন। গ্রাহকের গুরুত্ব ও ব্যাংক-গ্রাহকের সম্পর্ক বিবেচনায় তার কাছ থেকে চেক জমা রেখে নগদ টাকা দেওয়া হয়। পরের দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিমের উপস্থিতিতে গ্রাহকের চেক ডেবিট করে টাকার সমন্বয় করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকের অর্থ হারানোর মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তারপরও বিষয়টি যথাযথভাবে তদন্তের জন্য ইতোমধ্যে ক‌য়েক‌টি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে।

বিষয়টির সঠিক তদন্তের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে— জানান ডিএমডি হাসান ইকবাল।

প্রসঙ্গত, ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিশ্চিতে ২০১৩ সালে ইউনিয়ন ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ইসলামি মূল্যবোধ সেভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। শুধু ভল্ট থেকে টাকা সরানো নয়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোর বিশেষ ২০০ কোটি টাকার তহবিলের নীতিমালাও লঙ্ঘন করে ব্যাংকটি। এ কারণে সম্প্রতি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সম্প্রতি ইউনিয়ন ব্যাংককে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ব্যাংকটি ৪২ কোটি ৮০ লাখ সাধারণ শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৪২৮ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করবে। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। অঙ্কে যার পরিমাণ ৪৩৪ কোটি টাকা।

এসআই/এমএআর/