ব্যাংক খাতের বৃহৎ ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত ‘এ্যাননটেক্স’ গ্রুপ। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক। যার বেশির ভাগই আদায় করা সম্ভব হয়নি। তারপরও বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপটিকে আরও ঋণ সহায়তা দিতে চায় জনতা ব্যাংক। এর পক্ষে সায়ও দিয়েছে খোদ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এ্যাননটেক্স গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য পাওয়া যায়। ফলে গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য এর আগে আবেদন করলেও বিধিসম্মত না হওয়ায় তা বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেটি এবার উপর মহলের চাপে নিয়ম লঙ্ঘন করে অনুমতি দিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।

ঋণ জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে এ্যাননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়। যা এখন সুদসহ বেড়ে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে

মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনতা ব্যাংককে এ্যাননটেক্স গ্রুপের তিন হাজার ৭৪২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বিশেষ সুবিধায় সহজ শর্তে পুনঃতফসিলের জন্য অনাপত্তি সনদ (এনওসি) দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঋণ জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে এ্যাননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়। যা এখন সুদসহ বেড়ে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, এ্যাননটেক্স গ্রুপের ১৬টি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া ঋণ বিশেষ সুবিধায় ডাউন পেমেন্ট হিসাবে মাত্র ৮৬ কোটি টাকা পরিশোধ করবে। এই সুবিধা দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মবহির্ভূত; কারণ যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি, তাদের এই সুবিধা পাওয়ার কথা নয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এ্যাননটেক্স গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য পাওয়া যায়। ফলে গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য এর আগে আবেদন করলেও বিধিসম্মত না হওয়ায় তা বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেটি এবার উপর মহলের চাপে নিয়ম লঙ্ঘন করে অনুমতি দিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা

২০১৮ সালে তদন্ত করে এ্যাননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ অনিয়ম ও অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি খুঁজে পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

২০১৯ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে ‘ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা’ জারি হয়। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ-বহির্ভূত (রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি) কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেসব উদ্যোক্তা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না কেবল তাদের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেওয়া যাবে। তবে এর বাইরে অন্য কোনো কারণে খেলাপি হলে তিনি আর এই সুবিধা পাবেন না। অর্থাৎ জাল-জালিয়াতি করে ঋণ নিয়ে খেলাপি হলে তিনি এই নীতিমালার আওতায় তা নবায়ন করতে পারবেন না। এমন নির্দেশনা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরস্পরবিরোধী ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এ্যাননটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ইউনূস বাদল / ফাইল ছবি

তারা বলছেন, এভাবে প্রভাবশালীদের চাপে সুবিধা দিতে থাকলে ‘অনিয়মকারী’ আগামীতে আরও বেশি উৎসাহিত হবেন। আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। এ কারণে এখন মন্তব্য করতে পারছি না।’ সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জেনে পরে জানাব— বলেও আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের ফোন রিসিভ করেননি।

তবে, ব্যাংকটির চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমান বলেন, আইন অনুযায়ী সব নিয়ম মেনেই দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ রি-শিডিউলের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করি। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যাংক রি-শিডিউল করতে পারে না। আমরা আইন অনুযায়ী সব করেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টির অনুমোদনও দিয়েছে।

জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমান / ফাইল ছবি

তিনি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা আছে। পাশাপাশি ব্যাংকের খেলাপি টাকাও আদায় করতে হবে। কারণ, যত বেশি খেলাপি থাকবে তত বেশি প্রভিশন রাখতে হবে। না রাখলে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়বে, মূলধনেও ঘাটতি দেখা দেবে। আর রি-শিডিউল করলে এখন ব্যাংক ৭০/৮০ কোটি টাকা পাবে। না করলে তো পাবে না।

অনিয়মের সময় দায়িত্বে থাকা পর্ষদ সদস্যদের সমালোচনা করে ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান আরও বলেন, তাদের সময়ের অনিয়মের দায় এখন আমাদের বহন করতে হচ্ছে। তারা যদি সঠিক নিয়মে ঋণ দিত তাহলে এত বড় খেলাপি হতো না।

বাংলাদেশ ব্যাংক / ফাইল ছবি

প্রসঙ্গত, জনতা ব্যাংক গত বছরের ২৯ নভেম্বর এ্যাননটেক্সের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করে। আবেদনে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির তিন হাজার ৭৪২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে পুনঃতফসিলের অনুরোধ জানানো হয়।

গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকে গ্রুপটির মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ছয় হাজার ৫২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১৯ সালে পুনঃতফসিল করা হয় দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। এখন বাকি টাকা নিয়মিত করতে চায় অনিয়মের সঙ্গে জড়িত আলোচিত এ্যাননটেক্স গ্রুপ।

এসআই/এমএআর/