শুল্ক ফাঁকি বন্ধ ও আমদানি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউসগুলোতে অটোমেটেড সফটওয়্যারের যাত্রা শুরু হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট গত ১৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ওই সিস্টেম চালু করেছে। এর ফলে দেশের ৬টি ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউসে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আসা সিগারেট ও মদের যথাযথ হিসাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগ হতে থাকবে।

ওয়্যার হাউসগুলো হলো- ঢাকা ওয়্যার হাউস লিমিটেড, সাবির ট্রেডার্স লিমিটেড, ন্যাশনাল ওয়্যার হাউস, টস বন্ড প্রাইভেট লিমিটেড, ইস্টার্ন ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিস অ্যান্ড কবির অ্যান্ড কোং ও পর্যটন করপোরেশন অ্যান্ড বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।

কূটনৈতিক অঙ্গনে কর্মরত ব্যক্তি ও দেশে অবস্থানরত বিদেশি ‘প্রিভিলাইজড পারসনদের’ জন্য আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী শুল্কমুক্ত সুবিধায় মদ আমদানি করা যায়। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী সব দেশই এ সুবিধা দিতে বাধ্য। 

এ বিষয়ে কাস্টমস বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ২০২১ সালের ২ জুলাই অটোমেশনের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বন্ডেন্ড হাউসগুলোর আপত্তির কারণে বিষয়টি আটকে ছিল। আইনি জটিলতা নিষ্পত্তির পর সফটওয়্যারটি চালু করা হয়েছে। এখন ওয়্যার হাউসগুলো আমদানি করা মদ ও অন্যান্য পণ্যের তথ্য সফটওয়্যারে দেওয়া শুরু করেছে। ফলে শুল্কমুক্ত মদ ও সমজাতীয় অন্যান্য পণ্য আমদানি ও বিক্রি কাজে নয়-ছয় করার সুযোগ থাকবে না।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে অবস্থানরত ডিপ্লোম্যাটস ও প্রিভিলাইজড পারসন শুল্ক-করমুক্তভাবে ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউস থেকে আমদানি করা মদ, মদ জাতীয় পণ্য, সিগারেট ইত্যাদি ক্রয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড অটোমেশন সিস্টেম প্রণয়ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর।

এনবিআরের ওই আদেশে বলা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইস্যুকৃত ট্যাক্স একজামশন সার্টিফিকেট (টিইসি) ও ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের ইস্যুকৃত পাস বইয়ের বিপরীতে বাংলাদেশে অবস্থানরত ডিপ্লোম্যাটস ও প্রিভিলাইজড পারসন শুল্কমুক্তভাবে ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউস থেকে আমদানি করা মদ, মদ জাতীয় পণ্য, সিগারেট ইত্যাদি ক্রয় করে থাকেন। ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউসের কার্যক্রম ডিজিটাল প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা দেওয়ার স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও দ্রুততম সেবা প্রদান নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

তাই ওই সেবা নিশ্চিত করতে এনবিআর একটি ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড অটোমেশন সিস্টেম সফটওয়্যার প্রণয়ন করেছে। যা ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউসকে অনুসরণ করে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

একই সঙ্গে ওই আদেশের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউসকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পৃথক পৃথক কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম

* বিদেশি কূটনীতিক ও সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে চাহিদাকৃত পণ্য সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট তথ্য ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড অটোমেশন সিস্টেমে আপলোড করবে এবং সিস্টেম থেকে প্রাপ্ত ইলেকট্রনিক স্বাক্ষরযুক্ত টিইসি স্টেকহোল্ডারদের জন্য প্রস্তুত করবে।

* বিদেশি কূটনীতিক ও সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রাপ্যতা সংক্রান্ত নীতিগত কোনো পরিবর্তন হলে অথবা উক্ত সিস্টেমে কোনো পরিবর্ধন বা পরিমার্জন প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে তা এনবিআর করবে।

* উক্ত সিস্টেম সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।

* ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড অটোমেশন সিস্টেমে বিদেশি কূটনীতিক ও সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রদত্ত ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি এনবিআরের সঙ্গে সমন্বয় করবে।

এনবিআরের কার্যক্রম

এনবিআরের কাস্টমস বিভাগ রফতানি ও বন্ড শাখা ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড অটোমেশন সিস্টেমে লগইন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত বিদেশি কূটনীতিক ও সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রাপ্যতার তালিকা অনুসরণ করে ওয়্যার হাউসের আমদানি প্রাপ্যতার সীমা এন্ট্রি করবেন।  যা প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত দ্বিতীয় সচিব নিশ্চিত করবেন।

কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কার্যক্রম

* এনবিআরের পাসবই ইস্যু করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ করে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অবিলম্বে ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড অটোমেশন সিস্টেমে তা আপলোড করবে। একই সঙ্গে পাসবইয়ের তথ্যগুলো হালনাগাদ করবে।

* ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউসে দায়িত্বপ্রাপ্ত বন্ড কর্মকর্তা ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউসগুলোর মাধ্যমে এন্ট্রি করা আমদানি ও বিক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য যথাযথভাবে ইন-টু-বন্ড ও এক্স বন্ড কার্যক্রম নিশ্চিত করবেন। এছাড়াও তিনি প্রতিটি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে টিইসি ও পাসব ইয়ের তথ্য যথাযথভাবে এন্ট্রি হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করবেন।

ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউসের কার্যক্রম

* প্রতিটি ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউস পণ্য আমদানি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য- যেমন: বিল অব এন্ট্রি নম্বর ও তারিখ, অফিস কোড, ইনভয়েস নম্বর ও তারিখ এবং ক্রয় করা পণ্যের নাম, পরিমাণ, সিআইএফ মূল্য ইত্যাদি ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড অটোমেশন সিস্টেমে এন্ট্রি করবে।

* পণ্য বিক্রির সময় ওয়্যার হাউসগুলো ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড অটোমেশন সিস্টেমে লগইন করে পাসবই ও টিইসির নম্বর এবং পাসপোর্টের তথ্য যাচাই করে ডিপ্লোম্যাটস ও প্রিভিলাইজড ব্যক্তির কাছে বরাদ্দ অনুযায়ী পণ্য বিক্রি নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি বিক্রয় করা পণ্যের নাম ও পরিমাণ, বিল অব এন্ট্রি নম্বর, সিআইএফ মূল্য প্রভৃতি তথ্য সিস্টেমে এন্ট্রি করবে।

এনবিআরের আইটি অনুবিভাগের কার্যক্রম

* ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড অটোমেশন সিস্টেমে বিদেশি কূটনীতিক ও সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দেওয়া ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

* সিস্টেমের নিরাপত্তা বিধান, নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ, ব্যবহারকারীদের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ইলেকট্রনিক স্বাক্ষর প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

* এছাড়াও স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ের মাধ্যমে সিস্টেমের প্রয়োজনীয় মডিফিকেশন, ডেভেলপমেন্ট ও আপগ্রেডেশন নিশ্চিত করবে।

* সিস্টেম পরিচালনার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্যান্য ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার লিটার মদ শুল্কমুক্ত সুবিধায় ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউসের মাধ্যমে আসে। সেখানে বৈধভাবে মদ আমদানিতে শুল্ক-কর সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ শতাংশ দিতে হয়। বিশেষ সুযোগে আসা এসব মদের একটি বড় অংশ খোলাবাজারে কিংবা বারগুলোতে বিক্রির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এর বাইরেও বিশাল পরিমাণ মদের অবৈধ বিক্রির অভিযোগ তো আছেই। সে কারণেই শুল্কমুক্ত সুবিধায় মদসহ অন্যান্য পণ্যের অপব্যবহার বন্ধে অটোমেটেডের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর।

আরএম/জেডএস