উৎপাদন বন্ধ। শেয়ারহোল্ডারদের ঘোষিত লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ এমনিতে ঋণগ্রস্ত। পর্ষদের কেউ বলতে পারছেন না কোম্পানিটির ভবিষ্যৎ কী হবে? উল্টো ঘোষিত লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের না দেওয়াসহ নানা অনিয়মের কারণে কোম্পানির পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশন (বিএসইসি)।

এদিকে, সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ না করা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও পর্ষদ এখন বিএসইসির দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। যাতে কোম্পানির পর্ষদ না ভাঙে। এ অবস্থায় চরম হতাশায় বিনিয়োগকারীদের কেউ ঘুরছেন আদালতে, আবার কেউ ঘুরছেন রাস্তায় রাস্তায়। 

বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিতে চাচ্ছেন কিন্তু ফ্লোর প্রাইজের কারণে শেয়ারও বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ করে সবদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।

কোম্পানিটি সম্পূর্ণরূপে করাপ্টেড। আইপিওতে এসেছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কিছুদিন পরই শুরু হয় পর্ষদ গ্রুপিং। রাতের আঁধারে করেছে এজিএম, হয়েছে মারামারি। তো এ কোম্পানির কাছে বিনিয়োগকারীরা আর কী পাবে

অধ্যাপক আবু আহমেদ, পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএসইসি’র উচিত কোম্পানিটির পর্ষদ পুনর্গঠন করে প্রশাসন নিয়োগ করা। ঘোষণা দিয়েও লভ্যাংশ না দেওয়ায় কোম্পানির পর্ষদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা। তাহলে অন্যান্য কোম্পানিও সঠিক পথে আসবে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ লি.

বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, বিনিয়োগকারীরা ৩০ জুন ২০১৯ সালের জন্য ঘোষিত লভ্যাংশ না দেওয়া কোম্পানিটির বিরুদ্ধে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বিএসইসির কাছে অভিযোগ করে। লভ্যাংশের ঘোষণা দিয়ে উদ্যোক্তা-পরিচালকরা বেশি দামে শেয়ার বিক্রির কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের ঘোষিত লভ্যাংশ না দিয়ে শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।

সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজে বিনিয়োগকারী চট্টগ্রামের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন ঢাকা পোস্টের কাছে অভিযোগ করে বলেন, কোম্পানির ভালো অবস্থা দেখে ২০১৯ সালে বিনিয়োগ করি। কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার (লভ্যাংশ) কোনো হদিস পাচ্ছি না। পরে শুনি কোম্পানির কারখানা বন্ধ। কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু কোনো উত্তর পাচ্ছি না। এখন শেয়ারও বিক্রি করতে পারছি না। জানতে পারছি না কোম্পানির ভবিষৎ কী?

ঘোষিত নগদ লভ্যাংশ পরিশোধে ব্যর্থতার দায়ে সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে ডিপোজিটরি আইন ১৯৯৯ এর ১৩ ধারা অনুসারে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি। কমিটি কাজ করছে। তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আইনানুগ ব্যবস্থা

মোহম্মদ রেজাউল করিম, নির্বাহী পরিচালক, বিএসইসি

আলমগীর হোসেনের মতো শতশত বিনিয়োগকারীর এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন প্রথমেই সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের সব পরিচালকের বিও হিসাব জব্দ করে। এরপর কোম্পানির অনিয়ম খতিয়ে দেখতে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান হাওলাদার ইউনূস অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসকে বিশেষ অডিট করার জন্য নিয়োগ দেয়। তাদের প্রতিবেদনে অনিয়ম দেখার পর অধিকতর তদন্তের জন্য পুনরায় কমিটি গঠন করে কমিশন। ফলে কমিশনও কোম্পানিটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিচ্ছে।

সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুল হাসান

জানা গেছে, অধিক মুনাফা দেখিয়ে ২০১৪ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ না দেওয়ার জন্য সবধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সম্প্রতি পর্ষদের পরিচিত শতাধিক বিনিয়োগকারী আদালতে একটি আবেদন করেন। সেখানে বলা হয়, ঘোষিত ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ যেহেতু কোম্পানিটি দিতে পারছে না, তাই নগদ লভ্যাংশের পরিবর্তে বোনাস শেয়ার দেয়া হোক। এছাড়া আরেকটি রিট পিটিশনের মাধ্যমে কোম্পানিটির ১৬তম বার্ষিক সাধারণ সভার অনুমোদন দেওয়া হয়।

সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ না করা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও পর্ষদ এখন বিএসইসির দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। যাতে কোম্পানির পর্ষদ না ভাঙে। এ অবস্থায় চরম হতাশায় বিনিয়োগকারীদের কেউ ঘুরছেন আদালতে, আবার কেউ ঘুরছেন রাস্তায় রাস্তায়

এদিকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে কোম্পানিটির মুনাফা হওয়ার পরও শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ না দেওয়ায় গত ৫ জানুয়ারি জাহাঙ্গীর আলম নামের আরও এক বিনিয়োগকারী কমিশনে অভিযোগ করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ২০২০ সালেও কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছে কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করা হচ্ছে না। আমি এর বিচার চাই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ সঠিক’ বলে স্বীকার করেন কোম্পানির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুল হাসান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাসহ আর্থিক সংকটের কারণে আমরা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারিনি। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে কোম্পানিটি চালুর বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা কমিশনে উপস্থাপন করেছি। আমাদের ব্যাংক হিসাবগুলোও জব্দ রয়েছে, সেগুলো খুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। এছাড়া কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক মনোনয়নের জন্য অনুরোধ করেছি। কমিশন অনুমোদন দিলে আমরা কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।

করোনাসহ আর্থিক সংকটের কারণে আমরা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারিনি। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে কোম্পানিটি চালুর বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা কমিশনে উপস্থাপন করেছি। আমাদের ব্যাংক হিসাবগুলোও জব্দ, সেগুলো খুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি

ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুল হাসান, চেয়ারম্যান, সুহৃদ

কবে থেকে কোম্পানির উৎপাদন শুরু হতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনই কিছু বলতে পারছি না। কারণ কারখানা বেশকিছু দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে, এগুলো শোধ করতে হবে। তার জন্য নতুন ফান্ড দরকার। ফান্ড পেলে কোম্পানি চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশন (বিএসইসি)

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘোষিত নগদ লভ্যাংশ পরিশোধে ব্যর্থতার দায়ে সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে ডিপজিটরি আইন ১৯৯৯ এর ১৩ ধারা অনুসারে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি। কমিটি কাজ করছে। কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কারখানা বেশকিছু দিন ধরে বন্ধ। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে, এগুলো শোধ করতে হবে। তার জন্য নতুন ফান্ড দরকার। ফান্ড পেলে কোম্পানি চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে

ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুল হাসান, চেয়ারম্যান, সুহৃদ

সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের বর্তমান শেয়ার সংখ্যা পাঁচ কোটি ৭৩ লাখ ৬৭ হাজার ৭৫০টি। এর মধ্যে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে আছে মোট শেয়ারের ১২ দশমিক ১ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ১৯ দশমিক ২১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৬৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ শেয়ার।

২০২০ সালের জুন থেকে কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটির কাছে এনআরবি ব্যাংকের ঋণ রয়েছে নয় কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এছাড়া ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের ঋণ রয়েছে দুই কোটি টাকার বেশি।

সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের বর্তমান শেয়ার সংখ্যা পাঁচ কোটি ৭৩ লাখ ৬৭ হাজার ৭৫০টি। এর মধ্যে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে আছে মোট শেয়ারের ১২ দশমিক ১ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ১৯ দশমিক ২১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৬৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ শেয়ার

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোম্পানিটি সম্পূর্ণরূপে করাপ্টেড (দুর্নীতিবাজ)। আইপিওতে এসেছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কিছুদিন পরই শুরু হয় পর্ষদ গ্রুপিং। রাতের আঁধারে করেছে এজিএম, হয়েছে মারামারি। তো এ কোম্পানির কাছে বিনিয়োগকারীরা আর কী পাবে? কমিশনের উচিত, এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার করা। যাতে নতুন করে কোনো কোম্পানির এমন পরিস্থিতি হতে না পারে।

এমআই/এমএআর