করপোরেট কর হার কমিয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। কর আহরণের নতুন খাত আবিষ্কার, কর আহরণ সিস্টেম অটোমেশনসহ করদাতাবান্ধব পরিবেশ তৈরির দিকেও জোর দিয়েছেন তারা।

বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রাক বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করেন অর্থনীতিবিদরা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় এনবিআর সদস্য (কাস্টমস নীতি) মো. মাসুদ সাদিক সভাপতিত্ব করেন।

বৈঠকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী সৈয়দ ইউসুফ সাদাত এবং মুনতাসির কামাল প্রস্তাব তুলে ধরেন। এছাড়াও বৈঠকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম, যুক্তরাজ্যভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান পিডাব্লিউসির ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশিদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর রপ্তানিতে অনেক সুযোগ সুবিধা হারাব। ওই সময় আমাদের ব্যবসায়ীদের কর সুবিধা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে। ওই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

তিনি বলেন, বর্তমান আমাদের করপোরেট কর হার আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। তাই করপোরেট কর হার কমিয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গত দুই বাজেটে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর কমিয়ে বর্তমানে দেশের করপোরেট কর হার ৩০ শতাংশ হয়েছে। আর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। অথচ চীন, ভারত ভিয়েতনামসহ আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর করপোরেট কর হার ক্ষেত্র বিশেষ ১৫ শতাংশেরও নিচে। তাই ব্যবসায়ীদের কর কমানোর দাবি যৌক্তিক। 

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি আমরা কর হার কমিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। কিন্তু আমাদের রাজস্ব আদায় কমেনি বরং বেড়েছে। কর দাতা এবং সংগ্রহকারীর মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে হবে। কারণ করদাতা যদি মনে করেন যে কর দিতে তার দূরে যেতে হবে, তাহলে তিনি কর দিতে উৎসাহ পাবেন না। বরং করাদাতা যেখানে থাকেন সেখান থেকেই যদি কর পরিশোধ করার সিস্টেম থাকে তাহলে করদাতা কর দিতে উৎসাহিত হবেন। তাই কর ব্যবস্থা অটোমেশন ও রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনায় যথাযথ স্থানে লোকবল নিয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

আলোচনায় অর্থনীতি সমিতির সদস্য জামাল উদ্দিন আহমেদ দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স নবায়ন ফি পর্যন্ত নেওয়া হয় না জানিয়ে বলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ফি দেওয়ার পর, আর নবায়ন ফি দিয়েছেন বলে আমার মনে নেই। এ সময় তিনি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর ওপর টার্ন ওভার কর বসানোর পরামর্শ দেন।

আলোচনায় পিডাব্লিউসির ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশিদ বলেন, আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংস্থার কাছ থেকে ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ হারে কর নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে আসার উৎসাহ পায় না। তাই এই কর কমানোর প্রস্তাব করছি।

অন্যদিকে স্নেহাশিষ মাহমুদ কোম্পানির প্রতিনিধি স্নেহাশিষ বড়ুয়া দেশের সিটি করপোরেশনগুলোতে হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে টিআইএন বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে টিআইএন বাধ্যতামূলক করলে তারা অবশ্যই কর দিতে বাধ্য। এ সময় জমির খাজনা দেওয়ার ব্যবস্থায়ও ই-টিআইএনের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি। 

তিনি বলেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুনাফার ওপর কর (ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স) আদায় নিশ্চিত করতে পারলে দেশে দেশের স্বচ্ছতা বাড়বে। সম্পদ শতভাগ বৈধ হওয়ায় সম্পদশালীদের অস্থিরতা কমবে। ১৯৯৮ সালের এক আইন অনুসারে কোনো বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে লিয়াজো অফিস করলে সেই কোম্পানি যদি মনে করে যে তার লেনদেন কর তার নিজের দেশে দেবে তাহলে দিতে পারে। এই আইন বাতিলের পরামর্শ দেন তিনি।

অনুষ্ঠানে সিপিডি প্রতিনিধি সৈয়দ ইউসুফ সাদাত নতুন বাজেটে তামাকের ওপর কর স্ল্যাব না করে শলাকা হিসাবে কর বসানোর প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবে প্রতি শলাকায় ১০ টাকা হারে কর বসানোর পরামর্শ দেন।

আলোচনায় বক্তারা ৭০ লাখ টিআইএনধারী হলেও কর দিচ্ছেন মাত্র ২৪ লাখ করদাতা, বাকিরা কেন কর দিচ্ছে না? তা নিয়ে গবেষণার পরামর্শও দেন।

আরএম/এসকেডি