অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ নিয়ম শিথিল করে খেলাপিদের সুযোগ দিয়েছে। খেলাপিরা এ সুযোগ নিয়েও ঋণ পরিশোধ করেনি, বরং খেলাপি ঋণ বাড়ছে। খেলাপি ঋণ এখন জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অপরদিকে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বড় বড় ব্যবসায়ীরা টাকা পাচার করেন বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

তারা বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এককভাবে আর্থিক খাত মোকাবিলা সম্ভব নয়। ২০১৯ সাল থেকে খেলাপি ঋণ কমাতে গিয়ে বেশ কিছু নিয়ম-নীতিতে শিথিলতা দেওয়ার পরও কোনো সুফল হয়নি, উল্টো খেলাপি বেড়েছে। তারা আরও বলেন, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে গেলে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, এখানে রাতারাতি কিছু করা সম্ভব নয়।

সোমবার (২২ মে) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের অফিসে ব্যাংক খাত নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকাররা এসব কথা বলেন। ‘ব্যাংকিং সেক্টর আউটলুক-২০২৩’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেড (এবিবি)।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন। আরও উপস্থিত ছিলেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম এম শিরিন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী এবং মিডল্যান্ড ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান-উজ জামান। এ চারজন এবিবির ভাইস-চেয়ারম্যান।

এক প্রশ্নের জবাবে এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি কিংবা ডলার সংকটের চেয়ে ব্যাংক খাতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ খেলাপি ঋণ। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ এখন আর ব্যাংকের একার সমস্যায় নেই। এটা এখন জাতীয় সমস্যা। যদি সমাজ ও দেশের একজন হিসেবে এ সমস্যার সমাধান না করতে পারি, তাহলে এর সহজ কোনো সমাধান আসবে না।

তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে গত চার-পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন রকম নিয়মকানুনে যে শিথিলতা আনা হয়েছিল বিশেষ করে ২০১৯ থেকে ২০২০ সালে। কারণ অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করেছিল যে, তাতে আমাদের উদ্যোক্তারা বা বড় বড় ব্যবসায়ীরা কিছু সুবিধা পেয়ে রি-পেমেন্ট করবে। কিন্তু আসলে দেখতে পেয়েছি চার বছর পরও কোনো লাভ হয়নি। খেলাপি ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ৩-৪ মাস আগে বলেছিলাম, তিনিও বলেছেন, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মানের প্রভিশনিং ও ক্লাসিফিকেশনের যে নিয়মকানুনগুলো রয়েছে সেগুলোর দিকে যেতে হবে। সেটা একদিন, একমাস কিংবা তিন মাসে হবে না, সময়সাপেক্ষ।

ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে বড় রকম সামাজিক প্রতিশ্রুতি দরকার। খেলাপি ঋণের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে অনেক বিনিয়োগ দরকার, না হলে কিন্তু এ কাজ হবে না। যেমন অনেক কোর্ট-কাচারি দরকার, আরও অনেক আদালত দরকার। আর্থিক খাতের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দরকার।

তিনি বলেন, কোর্টের অনেক অভাব রয়েছে, অনেক ব্যবসায়ী অনেক সহজে স্টে অর্ডার বা স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে। তারা ক্লাসিফিকেশন করতে দেন না বা কোর্টে মামলার ওপর বছরের পর বছর স্টে অর্ডার চলে আসে।

সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে যে মূল্যস্ফীতির চাপ তা অনেকটাই আমদানির কারণে। পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি, প্রবাসী আয় বাড়ানো, একইসঙ্গে ডলারের দামের স্থিতিশীলতা এ মূল্যস্ফীতি কমাতে সাহায্য করবে। এখানে সুদের হার বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না।

তিনি বলেন, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে দেশে যে অর্থ পাচার সংঘটিত হচ্ছে তাতে বড় বড় ব্যবসায়ীরা জড়িত। এ অর্থ পাচারের পেছনে ব্যাংক খাত দায়বদ্ধ।

এবিবির চেয়ারম্যান বলেন, আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং হয়, এটা আমরা জেনেছি গত দেড়-দুই বছর আগে। কিন্তু এর অনেক আগে থেকেই এ পদ্ধতিতে টাকা পাচার হয়েছে। আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে টাকা পাচারের সুযোগ রয়েছে, যার সবগুলো উপায় ব্যাংকাররা জানেন না। সেই সু্যোগে এ পর্যন্ত মানি লন্ডারিং হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি এলসি নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের কারণে গত বছর থেকে এর হার অনেক কমে এসেছে।

আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে যে অর্থ পাচার হয় সে সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা এনবিআরও ততটা জানত না বলে জানান সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এবিবির ভাইস চেয়ারম্যান মাশরুর আরেফিন। তিনি বলেন, আগে আমাদের প্রতি মাসে ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো, কিন্তু তা এখন কমে সাড়ে ৪ বিলিয়নে এসেছে। কমে যাওয়া আড়াই বিলিয়নের মধ্যে এক বিলিয়ন তৈরি পোশাক খাতের মেশিনারিজ আমদানি এবং বাকি দেড় বিলিয়নের মধ্যে ওভার ইনভয়েসিং হতো, যা এখন কমে এসেছে।

সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, করোনার পর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে চলা অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে ব্যাংকিং খাত। ফলে আমানত বাড়ছে, কিন্তু সে তুলনায় ঋণ বিতরণ কমেছে। এ কারণে বর্তমানে প্রয়োজনের চেয়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল‍্য রয়েছে।

এমআই/এসএসএইচ/