উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যয় বেড়েছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে নানা শর্ত দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে মেয়াদপূর্তির পর যে হারে সঞ্চয়পত্র ভাঙেছে, সেই হারে নতুন বিনিয়োগ করেনি। গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র কিনেছে তার চেয়ে তিন হাজার ২৯৬ কোটি টাকা বেশি ভাঙিয়েছেন গ্রাহকরা। ফলে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ কমে ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধিতে নেমেছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক সময় সঞ্চয়পত্রের স্কিমের মেয়াদ শেষ হলে আবার সেখানেই বিনিয়োগ করতেন বেশিরভাগ গ্রাহক। তবে এখন যাদের স্কিমের মেয়াদ শেষ হচ্ছে তারা আর নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না। টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। যার কারণে গত অর্থবছরে বিক্রি চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধে বেশি অর্থ গুনতে হয়েছে সরকারকে।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) ৮০ হাজার ৮৫৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৮৪ হাজার ১৫৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো ৩ হাজার ২৯৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা সরকার তার কোষাগার ও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।

চলতি বছরে একক মাস জুনে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ১৩৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকার। বিপরীতে ওই মাসে মূল ও মুনাফা বাবদ সরকারকে পরিশোধ করতে হয়েছে ৬ হাজার ৪০৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এসময় নিট বিক্রির ঘাটতি (ঋণাত্মক) ছিল ২৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। 

এদিকে অতিমাত্রায় সুদ পরিশোধ কমাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নানা শর্ত দেওয়া হয়েছে। যার কারণে এ খাতে বিনিয়োগ ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধিতে নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বাজেটে ঘাটতি পূরণে সরকার সঞ্চয়পত্রের নির্ভরতাও কমিয়ে ফেলছে।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা ঠিক করছে সরকার। যা গেল অর্থবছরের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ১৭ হাজার কোটি টাকা কম। গেল অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য ঠিক করা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

গত পাঁচ অর্থবছরে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার ঋণ নেয় সরকার। পরের অর্থবছর (২০১৮-১৯) নিট ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা হয়। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেয় ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছর নেওয়া হয় ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকার ঋণ নেয় সরকার।

সঞ্চয়পত্রে নানা শর্ত
এখন ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। এছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। দুর্নীতি বা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে। এসব কড়াকড়ির প্রভাবে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে।

বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৫২, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮, তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হলেও এখনো তা ব্যাংকের তুলনায় বেশি।

এসআই/এসএম