সুশাসনের অভাব, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি ও পরিচালকদের হস্তক্ষেপের কারণে দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা ও উদ্বেগ বাড়ছে দেশের ব্যাংক খাতে। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ, অর্থপাচার, নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতি, অর্থের টান এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এই খাতে বিদ্যমান দুর্বলতাকে আরও নাজুক করে তুলেছে। 

২০২৩ সাল জুড়ে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষ নতুন করে কোনো অর্থ সঞ্চয় করতে পারেনি, উল্টো আগের সঞ্চয় ভেঙে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেছে। সামগ্রিক মন্দার ফলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধও কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে।

ব্যাংক খাতের এ দুর্দশার কারণে ভুগছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। এছাড়া, ২০২৩ সালে ‘‌ডি’ গ্রেড পাওয়া গভর্নরের সময়ে নানা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে ব্যাংক খাতে। সেসব ঘটনা ও পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে ব্যাংক খাতে বছরটা কেমন গেল তা ফিরে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

বছরের শুরুতে জানুয়ারিতে গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। বছর শেষে এখন গ্রস রিজার্ভ নেমে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারে। যদিও আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, বিপিএম-৬ ম্যানুয়ালে গ্রস রিজার্ভ ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ এখন আরও কম। এ অঙ্ক এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এই মজুত দিয়ে তিন মাসের দায় মেটানোও কঠিন

ডলার সংকট

বৈদেশিক মুদ্রার সংকট নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিল ২০২৩ সাল। বছরের প্রথম দিন ডলারের দাম বাড়ানোর বার্তা দেয় ব্যাংকগুলো। এক টাকা বাড়ানো হয় রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে রপ্তানি আয় সংগ্রহের দাম বেঁধে দেওয়া হয় ১০২ টাকায়। আর প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৭ টাকা। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দামের মধ্যে পার্থক্য দূর করে বাজারভিত্তিক করার দিকে জোর দেয় ব্যাংকগুলো। ফলে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম গিয়ে ঠেকে ১১১ টাকায়। সংকটে থাকা কিছু ব্যাংক চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রয়োজনীয় ডলার কেনে ১২৪-১২৫ টাকা দাম দিয়ে। এতে করে বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি মূল্য দিয়ে ডলার কিনতে হয় আমদানিকারকদের। খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ওঠে ১২৬ টাকা পর্যন্ত। সবশেষ এখন ডলারের দাম রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর বিক্রয় দর ১১০ টাকা। খোলা বাজারে এর মূল্য ১২২-১২৪ টাকা।

বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ সংকট

ডলার সংকটের সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় বছরজুড়ে ধারাবাহিকভাবে কমেছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ফলে বছরজুড়েই রিজার্ভ নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের শর্ত ছিল ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে অন্তত ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ থাকতে হবে। তাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এর প্রধান কারণ, চাহিদার তুলনায় বাজারে ডলার কম থাকায় চলতি বছর প্রতি মাসে গড়ে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

এ বছরের জুলাইয়ে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদ (স্মার্ট রেট) ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, আগস্টে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ; সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২০ শতাংশ

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বছরের শুরুতে জানুয়ারিতে গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। বছর শেষে এখন গ্রস রিজার্ভ নেমে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারে। যদিও আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, বিপিএম-৬ ম্যানুয়ালে গ্রস রিজার্ভ ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ এখন আরও কম। এ অঙ্ক এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এই মজুত দিয়ে তিন মাসের দায় মেটানোও কঠিন।

সুদের হারের ক্যাপ প্রত্যাহার

ব্যাংক ঋণের সুদ এক অঙ্কের ঘরে নামাতে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ৯ শতাংশ সুদহার বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে কমে যায় আমানতের সুদহারও। এতে করে ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহ হারায় সাধারণ সঞ্চয়কারীরা। একই সঙ্গে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়ার কারণে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতির চাপ। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তুলে দেওয়া হয় ঋণের ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা। পাশাপাশি নীতি সুদহারও বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে টাকা ধার করা বাড়িয়ে দেয় সরকার।

গত জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহারের নতুন নিয়ম চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ার পর ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশে উঠেছে। আমানতের সুদ হারও বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। যদিও উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা করা সম্ভব হয়নি।

২০২২ সালের ওপর এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকায়। খেলাপি ঋণ (এনপিএল), পুনঃতফসিল ঋণ ও অবলোপন ঋণ বিবেচনা করে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হিসাব করা হয়। উদ্বেগজনক এসব তথ্যে এ খাতে শঙ্কা তৈরি হয়

যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এখন ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, তা হলো ‘স্মার্ট’ বা ‘সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি’ বিল। প্রতি মাসের শুরুতে এ হার জানিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বছরের জুলাইয়ে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদ (স্মার্ট রেট) ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, আগস্টে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ; সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। এছাড়া, অক্টোবরে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ ও সর্বশেষ নভেম্বর মাসে স্মার্ট রেট বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। এ হিসেবে ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ ঋণের সুদহার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। কারণ, ব্যাংকগুলো এখন ঋণ দেওয়ার জন্য মার্জিন হিসেবে স্মার্ট রেটের সঙ্গে ৩ দশমিক ৭৫ ভিত্তি পয়েন্ট যুক্ত করতে পারে। তবে ডিসেম্বরে ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ব্যাংক ঋণের সুদ ছিল ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। কারণ, সিএমএসএমই, ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে অতিরিক্ত ১ শতাংশ তদারকি বা সুপারভিশন চার্জ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত জুন ও জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে তা আবার বেড়েছে। অক্টোবর মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর নয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে।

আইএমএফের ঋণ

বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল আইএমএফের ঋণ। বছরের শুরুতে গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে আইএমএফ, যা থেকে ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করে সংস্থাটি। দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের রিজার্ভ ও রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে আইএমএফের শর্ত বা লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হয়নি বাংলাদেশ। শর্ত শিথিল করে ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ছাড় করে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। ঋণের কিস্তি ছাড়ের সময় বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। আইএমএফ জানায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ এখন কম। তবে আশা করা যায়, স্বল্প মেয়াদে ধারাবাহিকভাবে তা বাড়বে। মধ্য মেয়াদে চার মাসের আমদানির ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণও থাকবে এ রিজার্ভ। তবে সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশের সামনে আছে উচ্চ মাত্রার অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি।

ব্যাংক খাতের নানা অনিয়মের খবরের পাশাপাশি এ বছর আলোচনায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিনের র‍্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের মূল্যায়নের খবর। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের র‍্যাঙ্কিং দেওয়া হয় ‘ডি গ্রেড’

আইএমএফের ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের একটি শর্ত ছিল বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করা। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেখানে ব্যাংকিং খাতের দুর্দশার চিত্র উঠে আসে।

আর্থিক স্থিতিশীলতা পর্যালোচনা প্রতিবেদনে (ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট) নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ব্যাংক খাতে যদি ৩ শতাংশ খেলাপি বাড়ে, একইসঙ্গে শীর্ষ তিনজন ঋণগ্রহীতা যদি খেলাপি হন, তাহলে বেশিরভাগ ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। ২০২২ সালের ওপর এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকায়। খেলাপি ঋণ (এনপিএল), পুনঃতফসিল ঋণ ও অবলোপন ঋণ বিবেচনা করে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হিসাব করা হয়। উদ্বেগজনক এসব তথ্যে এ খাতে শঙ্কা তৈরি হয়। 

খেলাপি ঋণ

বছরজুড়ে আলোচিত ছিল ‘খেলাপি ঋণ’। যা ‘ঠেকাতে’ অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। ঋণ পরিশোধে দেওয়া হয়েছে বিশেষ ছাড়, সঙ্গে নানান সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি’— এই বচনটাই বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন খেলাপিরা। ব্যাংকের টাকা নিজের মনে করে খাচ্ছে, শোধ করছে না। এর প্রভাব পড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণে। দেশের ব্যাংক খাতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা এ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায়। নয় মাসে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর-২৩) বেড়েছে ৩৪ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

‘‌ডি’ গ্রেডের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার

ব্যাংক খাতের নানা অনিয়মের খবরের পাশাপাশি এ বছর আলোচনায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিনের র‍্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের মূল্যায়নের খবর। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের র‍্যাঙ্কিং দেওয়া হয় ‘ডি গ্রেড’। একই র‍্যাঙ্কিংয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর শক্তিকান্ত দাস পান ‘এ প্লাস’ গ্রেড। প্রায় দেউলিয়া হতে যাওয়া শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল ভীরাসিংহে পান ‘এ মাইনাস’। আর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জামিল আহমেদ পান ‘সি মাইনাস’ গ্রেড।

অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তারল্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের ব্যাংকগুলোকে দৈনিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হয়েছে

১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গভর্নরদের মূল্যায়ন করে আসছে গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিন। ১০১টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে ২০২৩ সালের সবশেষ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে ম্যাগাজিনটি।
 
ব্যাংক খাতে লুটপাট

ব্যাংক খাতের নানা কেলেঙ্কারি নিয়ে সারা বছরই চলে আলোচনা। ‘নিয়ম-নীতি ভেঙে রাতের আঁধারে তোলা হয় ব্যাংকের টাকা’ এবং ‘নাম ছাড়া প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে টাকা, বেনামি ঋণে চলছে লুটপাট’— এসব খবরের সঙ্গে বছরের শেষ সময়ে এসে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি জানায়, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল এই ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ছোট-বড় ২৪টি অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেওয়া এ অর্থ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি। অনিয়মের তালিকায় ইসলামী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সাবেক ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ও এনআরবিসিসহ বিভিন্ন ব্যাংকের নাম রয়েছে।  

তারল্য সংকট

উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের ব্যয় বেড়েছে, কমেছে সঞ্চয় ক্ষমতা। ফলে বছরজুড়ে তারল্য সংকটে পড়েছে অনেক ব্যাংক। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ধার-দেনা করে চলেছে। আবার অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তারল্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের ব্যাংকগুলোকে দৈনিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হয়েছে।

চলতি বছরের নভেম্বর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তঃব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ব্যাংকগুলোকে ধার করতে হয়েছে ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এর আগে কখনো এত ধার নেওয়ার নজির নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে ব্যাংকের বাইরে থাকা মুদ্রার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। অক্টোবরে এটি কমে হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ কমায় ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে। জুন মাসে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা, যা অক্টোবরে বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। জুন মাসে ঋণ ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, অক্টোবরে যা বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ১ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া, গত অক্টোবরে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ, তবে ওই মাসে ঋণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।  

সংকটে পাঁচ ইসলামী ব্যাংক

নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে এখনো নগদ অর্থ সংকটে ভুগছে দেশের শরিয়াভিত্তিক পাঁচ ইসলামী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য সহায়তা সত্ত্বেও তারা তারল্য সংকট কাটাতে পারেনি। ব্যাংকগুলো হচ্ছে— ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এসব ব্যাংকের আমানত বাড়লেও তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে জমা করেনি। তাই বছর জুড়ে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) ও সংবিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত (এসএলআর) ঘাটতিতে ভুগছে ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংকের বেনামি ঋণ ও ঋণ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।

ভেঙে দেওয়া হলো ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ 

সুশাসনের অভাবে দীর্ঘদিন থেকে সমালোচিত হয়ে আসছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। এতদিন তাদের অনিয়মকে প্রশ্রয় দিলেও বছরের শেষ সময়ে এসে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ প্রদান, আমানত সংরক্ষণে ব্যর্থতা এবং সুশাসনের ঘাটতির অভিযোগে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি গঠন করা হয় নতুন পরিচালনা পর্ষদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ভূমিকাকে ভালো চোখে দেখেছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ ঘটনায় বলেন, ‘দেরিতে হলেও যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এটা ভালো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা আছে বলেই পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে।’

এসআই/কেএ