রক্ষক হয়েও ভক্ষকের ভূমিকা পালন করার অভিযোগ ওঠেছিল আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের বিরুদ্ধে। 

এছাড়া ঘুষের বিনিময়ে সহায়তা করার অভিযোগ ওঠে আরও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এই সুযোগে আর্থিক খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র।

পরে আদালতে ঘুষ কেলেঙ্কারির স্বীকারোক্তি দেন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডিসহ বেশ কয়েকজন। অনিয়মের অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরাও। 

এসব অভিযোগে নানা মহলের সমালোচনায় পড়ে আর্থিক খাতের এ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। বিষয়টি তদন্তে গঠন করা হয় ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (কারণ উদঘাটন) কমিটি। কিন্তু কমিটি গঠনের পর তিন মাস পার হলেও তদন্তে তেমন অগ্রগতি নেই। ফলে কমিটি এখন পর্যন্ত প্রতিবেদনও জমা দিতে পারেনি।

জানা গেছে, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ অন্তত পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এসব অর্থ লোপাটের তথ্য চাপা দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম। এসব অনিয়মের সহায়তা করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। বিনিময়ে পেতেন আর্থিক সুবিধা। ঘুষের বিনিময়ে এসব অনিয়মে সহায়তা করেছেন আরও  কয়েকজন কর্মকর্তা।

পিকে হালদারের অন্যতম সহযোগী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হকের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রাশেদুল হক।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে রাশেদুল হক বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে দিত রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজারবিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে প্রতি মাসে দেওয়া হত দুই লাখ টাকা করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেন, ‘২০০২ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে যেসব এজিএম-ডিজিএম ছিলেন, তারা বসে বসে মধু খেতেন। তাই তারা চুপ থাকতেন।’ এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে ‘চোর’ ও ‘ডাকাত’ বলেও উষ্মা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।

নিয়ন্ত্রণ সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আসা এসব অভিযোগে সমালোচনার ঝড় তো তোলেন অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা। এর পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টনক নড়ে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (কারণ উদঘাটন) কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কমিটিতে ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে প্রধান এবং বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের উপ মহাব্যবস্থাপক মো. সারোয়ার হোসেনকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান, ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মো. কবির আহাম্মদ, ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৪-এর মহাব্যবস্থাপক মো. নুরুল আমীন।

কমিটি গঠনের তিন মাস পর হলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। তদন্তে গড়িমসি চলছে এমন অভিযোগ করেছেন অনেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশিরভাগ কর্মী দক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ করেন। দু-একজন কর্মকর্তার জন্য সব বদনাম গ্রহণযোগ্য নয়। তাই যাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, সঠিক তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কিন্তু প্রথম থেকেই বিষয়টি নিয়ে গড়িমসি চলছে। তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। এভাবে অনিয়মের অভিযোগ এড়িয়ে গেলে আগামীতে অন্যান্য কর্মকর্তারাও অনিয়মে জড়িয়ে পড়বেন ।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গড়িমসি নয়, চলমান লকডাউনের কারণে তদন্তে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি এখনও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। কারণ লকডাউনের মধ্যে ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে পারেনি কমিটি। তবে খুব দ্রুতই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হবে।

কমিটির প্রধান ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খান জানান, করোনাভাইরাসের কারণে চলমান বিধিনিষেধে নিয়মিত কাজ করা সম্ভব হয়নি। তবে তদন্ত চলছে, শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।

এদিকে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ তদন্তের ধীরগতি  আর্থিক খাতের জন্য উদ্বেগজনক বলে আখ্যা অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিতে দ্রুত দুর্নীতির তদন্ত শেষ করা দরকার এবং অভিযুক্তরা দায়ী থাকলে তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুব দায়িত্বশীল পদে থাকা একজন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যতদ্রুত সম্ভব সঠিক তদন্ত শেষ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিতে এটি খুব জরুরি। 

তিনি বলেন, দোষীরা যদি পার পেয়ে যান, তাহলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো কঠিন হবে। কারণ, অন্যরা মনে করবেন অনিয়ম করলেও বিচার হয় না। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইমেজ যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, মানুষ যাতে আস্থা না হারায় সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে- বলে জানান সাবেক এ গভর্নর।

এদিকে বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের নানা অনিয়মের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন অনিয়ম দুর্নীতিতে অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা। তাদের অভিযোগ পিপলস লিজিংয়ের বর্তমান পরিচালকদের যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। 

এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ও বর্তমান ইডি শাহ আলম জড়িত। প্রায় দেড় বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রধান বিচারপতি, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সরকারের সংশ্লিষ্ট ১১টি প্রতিষ্ঠানে লিখিত আকারে এ অভিযোগ দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ২৮ জুলাইয়ে দেওয়া লিখিত অভিযোগে স্বাক্ষর করেন ৭৬ জন আমানত ও বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তা-শেয়ারহোল্ডাররা। তবে এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

এসআই/আরএইচ