করোনায় ক্ষতির মুখে পড়েছে ব্যাংকিং খাত

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ছোবল ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। সেই মহামারির আঘাত দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। যার ফলে কমেছে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানি-রপ্তানি। বন্ধ রয়েছে ঋণ আদায়। এতে করে ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত।  

মহামারির তাণ্ডবে গেল বছর ব্যাংকগুলোর ব্যবসা হয়নি। ঋণ আদায় না হওয়ায় কমেছে সুদহার। ফলে বেশিরভাগ ব্যাংকের কমেছে পরিচালন মুনাফা। 

নতুন বছরে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখলেও মহামারির অনিশ্চিত দুনিয়ায় অন্ধকারে রয়েছেন ব্যাংকাররা। কারণ একদিকে ভ্যাকসিন তৈরি হলেও তা পর্যাপ্ত নয়, অন্যদিকে আবারও কোভিড-১৯ নতুন রূপে ছড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে। তাই আগামীতে বিশ্ব পরিস্থিতি কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।    

নতুন বছর ব্যাংক খাতের অবস্থা কেমন হবে? জানতে চাইলে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রাধন নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন বছরটা খুব চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ আমরা বুঝতে পারছি না আগামীতে কী হবে। শিগগিরই এ মহামারি শেষ হবে, না-কি অবস্থা চলতে থাকবে- কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। 

ভ্যাকসিন তৈরি হলেও বাস্তবায়নে সময় নিচ্ছে। নতুন করে যুক্তরাজ্যে কোভিড-১৯ উপসর্গ দেখা দিয়েছে। সামনে আমাদের জন্য বড় ভাবনার বিষয় হলো- কীভাবে এটি মোকাবিলা করতে পারব। এখন কোভিড যদি নিয়ন্ত্রণে আসে তাহলে আশা করা যাচ্ছে আগামী বছরের মাঝামাঝি অর্থাৎ সেকেন্ড কোয়ার্টার থেকে আমরা স্বাভাবিক হতে পারব। আর যদি এটা নিয়ন্ত্রণে না আসে তাহলে আমাদের জন্য বড় বিপদ সংকেত। কারণ ২০২০ সালে যে ক্ষতি হয়েছে এতে করে সামনের সময় টিকে থাকাই কঠিন হবে। 

তিনি বলেন, মহামরিতে আমাদের কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে সরকারের বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ। সামনের দিনগুলোতেও টিকে থাকতে হলে ব্যাংক খাতের প্রণোদনা লাগবে। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন আগামীতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় নতুন করে প্রণোদনা দেওয়া হবে, এটা আমাদের জন্য ইতিবাচক।  

ইতোমধ্যে গার্মেন্টসের পেমেন্টের সময় বাড়ানো হয়েছে। আরও বেশকিছু ছাড় আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও কিছু সুবিধা প্রয়োজন বলে জানান ব্যাংকারদের এ নেতা।  

মহামরির ধাক্কা রপ্তানিতে লাগতে পারে আশঙ্কা করে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এ এমডি বলেন, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চলে কোভিডের নতুন উপসর্গ দেখা দেওয়ায় আমাদের রপ্তানি সমস্যা হতে পারে। কারণ আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক ইউরোপের বাজারে বেশি বিক্রি হয়। ওইসব দেশে যদি আমরা বাণিজ্য করতে না পারি তাহলে আগামী সময়টা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। তবে আমরা আশাবাদী। আগামীতে সব বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাব। এর জন্য প্রয়োজন সব ধরনের নীতি সহযোগিতা- বলেন এবিবির এ নেতা। 

এদিকে খেলাপি ঋণের বোঝায় বেশ কয়েক বছর ধরেই নড়বড়ে অবস্থায় দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক। ঋণের সুদ আয়ের চেয়ে বিভিন্ন চার্জ ও কমিশনে বেশি স্বস্তি পেত ব্যাংকগুলো। কিন্তু গেল বছর মহামারির ধাক্কায় ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতির হওয়ায় সেই আয়ও কমে গেছে। এর সঙ্গে গত এপ্রিল থেকে সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনায় সরাসরি আঘাত হেনেছে পরিচালন মুনাফায়। বিভিন্ন ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন তথ্য বলছে, ২০২০ সালে দেশের অধিকাংশ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা কমে গেছে।

গতবছর করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখা ও বেকারত্ব রোধে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার বিভিন্ন ঋণ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় যার অধিকাংশই বাস্তবায়ন করছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতে বন্ধ রয়েছে ঋণ আদায়। দেওয়া হচ্ছে নানা সুযোগ-সুবিধা। ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে রক্ষা করতে গিয়ে ব্যাংক খাত নিজেই এখন ধুঁকছে। 

নতুন বছর ব্যাংক ব্যবসা কেমন হবে- জানতে চাইলে বেসরকারি সাউথ ইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, বছরটা খুব একটা সুখকর হবে এটা মনে হচ্ছে না। মহামারি বছর পার করেছি। আমরা ধরে নিয়েছিলাম করোনা আর থাকবে না। কিন্তু করোনার নতুন ধরন দেখা দিয়েছে। আমাদের এখানে আক্রান্ত না হলেও এর প্রভাব পড়েছে। কারণ আমাদের পোশাক খাতের রপ্তারি ইউরোপ আমেরিকায়ই হয়। রপ্তানি কমে গেলে ব্যাংকের আয় কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা চাই বছরটা ভালো হোক কিন্তু বাস্তবতা আমাদের বিচার করতে হবে। পরিস্থিতি কী হতে যাচ্ছে তা কেউই অনুমান করতে পারছে না।

তিনি বলেন, গেল বছর কোভিড হলেও সরকারের স্টিমুলাস প্যাকেজসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন ছাড় ও সহযোগিতার কারণে ব্যাংকগুলোর ক্ষতি কিছুটা কম হয়েছে। সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতাগুলো অব্যাহত থাকলে এ বছরও ক্ষতি কম হবে। তবে যে ক্ষতি হচ্ছে তা পুষিয়ে নিতে বেশ কিছু বছর লেগে যাবে বলে জানান বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ এ কর্মকর্তা।

জানা গেছে, যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ এর নতুন ধরন (স্ট্রেইন) আতঙ্ক এখন পুরো ইউরোপ জুড়ে। এর আগেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কড়া লকডাউন চলছে। যেসব দেশ এখনো লকডাউন হয়নি, তারাও খুব শিগগির লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার চিন্তা করছে। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আকাশপথ, রেলপথসহ সব সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্য কার্যত ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া স্ট্রেইন বেশ কয়েকটি দেশে শনাক্ত হয়েছে। এটি করোনার মতো ছড়িয়ে পড়লে নতুন বছরে বিশ্ব অর্থনীতি আরও ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে।    

এসআই/এসএম