শুরু হয়েছে নতুন বছর। ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য এখন থেকেই আয়ের একটি অংশ সঞ্চয় করার কথা ভাবছেন অনেকেই। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে, কোথায় জমাবেন এ অর্থ? কেমন পাবেন সুদ বা মুনাফা? অথবা কতটুকু নিরাপত্তা পাবেন?

এদিকে সহজলভ্য ও ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ব্যাংকে টাকা জমানোই বড় ভরসা মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ। তবে সব ব্যাংকই একই ধরনের সুবিধা দেয় না। এক্ষেত্রে কষ্টার্জিত অর্থ কোন ব্যাংকে রাখলে একটু বেশি মুনাফা মিলবে, সে খোঁজে থাকেন সঞ্চয়কারীরা।

প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখাই মাসিক সঞ্চয় প্রকল্প বা ডিপিএস (ডিপোজিট পেনশন স্কিম)। ডিপিএস নামে বহুল প্রচলিত হলেও বিভিন্ন ব্যাংকে এর ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ডিপিএসের বিপরীতে মাসিক, ত্রৈমাসিক, ছয় মাসিক ও বাৎসরিক সুদ দিয়ে থাকে।

আরও পড়ুন : শর্তের জেরে সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে গ্রাহক

এছাড়া সর্বনিম্ন তিন মাস থেকে তিন বছর বা তারও বেশি সময়ের জন্য ব্যাংকগুলোতে সঞ্চয় করার সুযোগ রয়েছে। এসব সঞ্চয়ের বিপরীতে যে সুদ দেয়, তার নাম ফিক্সড ডিপোজিট রেট বা স্থায়ী আমানতে সুদের হার (এফডিআর)।

সবশেষ ২০২১ সালের ডিসেম্বরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫৯টি ব্যাংকের আমানতের সুদ বা মুনাফার পরিমাণ প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবগুলোর সুদহার এক রকম নয়। বিভিন্ন মেয়াদে সর্বনিম্ন ২ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত এফডিআরে সুদ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশও সুদ অফার করছে কয়েকটি ব্যাংক।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের মোট ৯টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এফডিআরে বিভিন্ন মেয়াদে সাড়ে ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ সুবিধা দিচ্ছে। সাধারণ ডিপোজিটে দিচ্ছে ২.৫০ থেকে ৪ শতাংশ।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। তিন থেকে ছয় মাসের কম সময়ের সুদ ৪ দশমিক ৫০ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ, ছয় মাস থেকে এক বছরের কম সময়ের জন্য ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং এক বছর থেকে তিন বছর মেয়াদি সময়ের সুদ ৫.৭৫ থেকে ৭ শতাংশ এবং তিন বছরের বেশি সময়ের ডিপোজিটের জন্য রাকাব ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ সুবিধা দিচ্ছে।

আরও পড়ুন : সঞ্চয়পত্রে শর্ত দিয়ে ব্যাংক ঋণে ঝুঁকছে সরকার

এছাড়া সোনালী, অগ্রণী, রূপালী, জনতা, বেসিক, বিডিবিএল, পিকেবি ও বিকেবির সুদ ৪.৫০ থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত আমানতকারীদের সুদ দিচ্ছে।

বেসরকারি ব্যাংক

বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সাধারণ সঞ্চয়ে ২ থেকে ৪ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। আর মেয়াদি আমানতে দিচ্ছে ৪ থেকে ৬ শতাংশ। তবে কিছু ব্যাংক মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৯ শতাংশ সুদ অফার করেছে। এই তালিকায় এগিয়ে আছে চতুর্থ প্রজন্মের নতুন ব্যাংক গুলো (মিডল্যান্ড, মেঘনা, পদ্মা ব্যাংক, ইউনিয়ন, মধুমতি, এসবিএসি প্রবাসী উদ্যোক্তাদের এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও এনআরবি গ্লোবাল)।

দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা (সাবেক ফারমার্স) ব্যাংক। ব্যাংকটি তিন থেকে ছয় মাস কম সময়ের সুদ ৬.২৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ, ছয় মাস থেকে এক বছরের কম সময়ের জন্য ৬.৫০ শতাংশ থেকে  ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং এক বছর থেকে তার বেশি সময়ের জন্য আমানতের সুদ দিচ্ছে ৭ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ। তিন মাস থেকে তিন বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য সাউথবাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসএবিসি) ৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ।

মেয়াদি আমানতের ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদ দিচ্ছে এবি ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, আইএফআইসি, আইসিবি, মার্কেন্টাইল, প্রিমিয়ার, উত্তরা ও ন্যাশনালসহ বেশকিছু ব্যাংক।

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক

দেশের শরিয়াহভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্‌, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, শাহজালাল, এক্সিম, ইউনিয়ন, আইসিবি ইসলামিক এনআরবি গ্লোবাল ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।এ ব্যাংকগুলো ৫ থেকে ৬ শতাংশ মুনাফা দিচ্ছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. বিভিন্ন মেয়াদি সঞ্চয়ের ওপর মুনাফা দিচ্ছে সাড়ে ৫ থেকে ৬.২৫ শতাংশ পর্যন্ত।

বিদেশি ব্যাংক

বিদেশি ব্যাংকগুলো সাধারণত আমানত কম সংগ্রহ করে, তাদের সুদহারও কম। এ খাতের বেশিরভাগ ব্যাংক মেয়াদি আমানতে ২ থেকে ৪ শতাংশ সুদ দিচ্ছে।

বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে তিন বছর থেকে তার বেশি সময়ের সবচেয়ে বেশি সাড়ে ৭ শতাংশ সুদ দিচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। হাবিব ব্যাংক সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৬ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। আর সবচেয়ে কম সুদ সিটি এনএ। ব্যাংকটির আমানতের সুদহার এক শতাংশের নিচে। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) মেয়াদি আমানতে সাড়ে ৩ শতাংশ থেকে ৫.৬০ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। এছাড়া এফডিআরে আল ফালাহ, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসি, ওরি, এবং কমার্শিয়াল ব্যাংক অফ সিলনের সুদের হার দশমিক ৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ পর্যন্ত।

আরও পড়ুন : মিথ্যা তথ্য দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনলে দণ্ড

মহামারিতে বিনিয়োগ-খরায় দেশের মুদ্রাবাজারে তৈরি হয়েছে অলস তারল্যের পাহাড়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতের সুদহার ইতিহাসের সর্বনিম্নে নিয়ে যায়। মহামারির আগে যেসব ব্যাংক গ্রাহকদের ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য ৬-৯ শতাংশ সুদ দিত, তারাই সুদহার নামিয়ে আনে দেড়-দুই শতাংশে।

এমন অবস্থায় ভবিষ্যতে ব্যাংকের আমানতের ওপর বিরূপ প্রভাব রোধে ঋণের সুদহারের মতো আমানতের সর্বনিম্ন সুদহারও বেঁধে দিয়ে গত বছরের ৮ আগস্ট একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকের তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদি আমানতের সুদ হার কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হবে না। দেশের ভোক্তা মূল্যসূচকের হিসাবে গড় মূল্যস্ফীতির সাড়ে ৫ শতাংশের ওপরে। সে হিসেবে এখন ব্যাংকের সর্বনিম্ন সুদহার সাড়ে ৫ শতাংশের ওপরে থাকার কথা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, তাদের এ নির্দেশনা বেশিরভাগ ব্যাংক যথাযথ পরিপালন করছে না।

এসআই/এমএইচএস