মালিকানার দ্বন্দ্বে বছরের পর বছর ব্যবসায় লোকসানের পাশাপাশি অর্ধযুগ ধরে উৎপাদন বন্ধ, নগদ অর্থ সংকট ও পাওনাদারদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থতাসহ ঋণের ভারে জর্জরিত জুট স্পিনার্স লিমিটেড এখন অস্তিত্ব সংকটে। বর্তমান অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে পৌনে দুই কোটি টাকার কোম্পানির ব্যাংক ঋণ ৪৯ কোটি টাকা! এর সঙ্গে গত এক দশকে কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান ২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোম্পানির সম্পদের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি লোকসান।

এদিকে, লাভের আশায় বিনিয়োগ করে পথে বসেছেন বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানিটির শেয়ারের সংখ্যা ১৭ লাখ। এর মধ্যে ৬০ দশমিক ১৮ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারী। বাকি ৩৯ দশমিক ৮২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, জুট স্পিনার্স লিমিটেডে বিনিয়োগ করে ২০১২ সালের পর থেকে কোনো লভ্যাংশ পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। শুধু তা-ই নয়, ২০১৬ সালের পর থেকে কোম্পানিটির বার্ষিক সাধারণ সভাও (এজিএম) হয়নি। ফলে এর মালিকরা (শেয়ারহোল্ডাররা) কোম্পানি সম্পর্কেও রয়েছেন অন্ধকারে। অন্যদিকে, এর পরিচালনা পর্ষদ রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যারা লাভের আশায় এখানে (জুট স্পিনার্স লিমিটেড) বিনিয়োগ করেছিলেন, এখন শেয়ারের লাভ তো দূরের কথা উল্টো কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়েও শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে এ মুহূর্তে কোম্পানিটি যদি অবসায়ন করা হয়, তবে শেয়ারহোল্ডারদের উল্টো পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধ করতে হবে ভর্তুকি দিয়ে। বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে কোম্পানির উৎপাদন শুরু করা জরুরি।

তারা বলছেন, জুট স্পিনার্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ শামস-উল হকের মৃত্যু হয় ২০১০ সালে। এরপর থেকে তার ছেলেরা কারখানাসহ সম্পদের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বে জাড়িয়ে পড়েন। শামস-উল হকের মৃত্যুর প্রথম দুই বছর অর্থাৎ ২০১২ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। এরপর থেকে ব্যাংকের ঋণ বৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রমিক জটিলতায় লোকসানে নিমজ্জিত হয় কোম্পানিটি। একপর্যায়ে চালাতে না পেরে ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘৫-৬ বছর ধরে কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ। এখন যদি নতুন করে উৎপাদনে যেতে না পারে তাহলে উচিৎ হবে দেনা-পাওনা হিসাব করে কোম্পানি অবসায়ন করা। তা না হলে ব্যাংকের ঋণের সুদ দিনদিন বাড়বে। ফলে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাবার পরিবর্তে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের দেনা পরিশোধ করতে হবে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুর্বল কোম্পানিগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। যারা নিয়মিত লোকসান করছে, এজিএম করছে না সেসব কোম্পানির বোর্ডের সঙ্গে আমাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। বেশকিছু কোম্পানির পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যারা ভালো করার সম্ভাবনা দেখাতে পেরেছে তাদের বোর্ডগুলো পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। আর কিছু দিন দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুঁজিবাজারে মহাধসের বছর অর্থাৎ ২০১০ সালে কোম্পানিটির ২০ হাজার শেয়ার কিনেছিলন শান্তা সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী আদিলুর রহমান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভালো মানের কোম্পানি দেখে ২০১০ সালের নভেম্বরে দুই দফায় কোম্পানির ২০ হাজার শেয়ার কিনি। শেয়ার কেনার পর বেশ লাভ হয়েছিল। কিন্তু ধসের পর থেকে শেয়ারের দাম কমতে থাকে। ২০১২ সাল পর্যন্ত কোম্পানি লভ্যাংশ দিয়েছিল, তাতেও ভালো মুনাফা আসে।

‘তারপর থেকে গত ৯-১০ বছরে কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা আট লাখ টাকা নেই। গত এক বছরে তিন হাজার শেয়ার বিক্রি করেছি। বাকি শেয়ার বিক্রি করতে পারছি না। বিক্রির অর্ডার দিলে ক্রেতা পাই না। আমি এ অবস্থার অবসান চাই।’

লোকসান ও ঋণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ শামস-উজ জোহা। তবে, কোম্পানির ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ও লোকসান থেকে মুনাফায় ফেরাতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সার্বিক বিষয়ে কোম্পানির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) তোফাজ্জাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সুতার খরচ ও মালিকানা দ্বন্দ্বে দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ। বর্তমানে কোম্পানির ব্যাংক ঋণ রয়েছে ৪৯ কোটি টাকা। এছাড়া পুঞ্জীভূত লোকসানে রয়েছে কোম্পানি। কমিশনের সহায়তায় উৎপাদনের চেষ্টা চলছে, ব্যাংকের ডাউন পেমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি উৎপাদন শুরু করতে পারব।’

এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ভারপ্রাপ্ত সিআরও শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোম্পানির আর্থিক অবস্থা খুবই দুর্বল। লিস্টিং বিভাগ বিষয়টি দেখছে।


 
জুট স্পিনার্স লিমিটেডের সার্বিক অবস্থা
 
নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে কোম্পানির নিট লোকসান হয়েছে সাত কোটি ৫৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) তিন প্রান্তিকে লোকসান আরও বেড়েছে। এ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের অনিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুসারে, শেয়ারপ্রতি কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ১০ টাকা ৮৩ পয়সা। ফলে শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদের মূল্য ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪৬ টাকা ৭ পয়সায়। শেয়ারটি গত বৃহস্পতিবার বাজারে লেনদেন হয় ১৩০ টাকা ৪০ পয়সায়।
 
কোম্পানির ঋণ 
 
১৯৮৪ সালে তালিকাভুক্ত এক কোটি ৭০ লাখ টাকার পরিশোধিত কোম্পানিটির ৪৯ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ রয়েছে। তবে, ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেখানো হয়েছে ৪০ কোটি ৬৮ লাখ ছয় হাজার টাকার ঋণ। এর মধ্যে ৩১ কোটি ৭৭ লাখ ছয় হাজার টাকা স্বল্পমেয়াদি এবং আট কোটি ৯১ লাখ টাকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। অর্থাৎ পাহাড়সমান ঋণ প্রতিষ্ঠানটির। এ ঋণের সঙ্গে কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান ২৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ঋণ ও লোকসান মিলে কোম্পানির কাছে পাওনা ৭৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে কোম্পানির সম্পদের মধ্যে রয়েছে ১০ দশমিক ২০ এককর জমি, কারখানা ও মেশিন।
 
শেয়ারের দর ওঠা-নামা
 
২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ১৮৫ টাকা ৬০ পয়সা। আট মাসে শেয়ারটির দাম ৫৫ টাকা ২০ পয়সা কমে গত বৃহস্পতিবার (১৯ মে) লেনদেন হয়েছে ১৩০ টাকা ৪০ পয়সায়। অর্থাৎ শেয়ারহোল্ডারদের ৫৫ টাকা করে লোকসান হয়েছে।
 
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ
 
২০১৬ সালের অডিট প্রতিবেদনে নিরীক্ষক শফিক বসাক অ্যান্ড কোম্পানি দেখিয়েছে, জুট স্পিনার্সের শ্রমিক জটিলতা, পাওনাদারদের টাকা পরিশোধে অক্ষমতা এবং ম্যানেজমেন্টের দুর্বলতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটি। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক হিসাব মান (আইএএস)-৩৬ অনুযায়ী প্রতি বছর কোম্পানির সম্পদ মূল্যায়ন শেষে ইমপেয়ারমেন্ট টেস্ট বাধ্যতামূলক (যদি থাকে)। পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ প্রতিষ্ঠানটির। ফলে আর্থিক বিবরণীতে সম্পদের প্রকৃত বাজারদরে পার্থক্য হওয়াটা স্বাভাবিক। এরপরও কর্তৃপক্ষ ইমপেয়ারমেন্ট টেস্ট (বৈকল্য পরীক্ষা) করেনি।
 
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি কোনো প্রকার রেজুলেশন ছাড়াই এমডির কাছ থেকে দুই কোটি ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এমডি ছাড়াও পরিচালক মুহাম্মদ শামস-উল-কাদিরের স্ত্রী আয়েশা কবিরের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের ৩৫ লাখ টাকা এখনও পরিশোধ করা হয়নি। কিন্তু সেই অর্থের ওপর গত পাঁচ বছরের জন্য ২২ লাখ ৭৫ হাজার টাকার সুদ ধরা হয়েছে। এভাবে জুট স্পিনার্স কর্তৃপক্ষ কোম্পানি আইন ও ইনকাম ট্যাক্স অধ্যাদেশ ভঙ্গ করে পরিচালকদের সঙ্গে অধিকাংশ লেনদেন নগদে করেছে বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষক।
 
কোম্পানির ইতিহাস ও লোকসানের কারণ
 
১৯৭৯ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ জুট অ্যান্ড টুয়াইন মিল মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ শামস-উল হক। তার উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত হয় জুট স্পিনার্স লিমিটেড কোম্পানি। প্রতিষ্ঠার পর বেশ সুনাম ছিল কোম্পানিটির। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পাটকলের পুরস্কারও পেয়েছিল। এছাড়া আইএসও সনদপ্রাপ্ত কোম্পানিটির তৈরি করা পণ্য তুরস্ক, মিসর, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, স্পেন, চীন, ভারত ও উরুগুয়েসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো।
 
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা মোহাম্মদ শামস-উল হক ২০১০ সালে মারা যাওয়ার পর থেকে কোম্পানির সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে ভাই-বোনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে শামসুল-উল হকের বড় ছেলে শামস-উল হুদা ও মেজো ছেলে মোহাম্মদ শামস-উজ জোহার মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। পিতার মৃত্যুর মাত্র ছয় বছরের মাথায় অর্থাৎ ২০১৬ সালে জুট স্পিনার্স লিমিটেডের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কোম্পানির তহবিল তছরুপ, শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ না করা, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।
 
এমআই/এমএআর