ঘুরে দাঁড়িয়ে ‘কোমর শক্ত’ না হতেই বারবার পতন হয় পুঁজিবাজারে। এতে প্রতিনিয়ত মূলধন হারান বিনিয়োগকারীরা। চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এবারের ধস এখনো অব্যাহত রয়েছে। তিন মাস ধরে চলা এবারের ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাড়ে ১৫ লাখ বিনিয়োগকারী। তাদের ক্ষতির পরিমাণ ৬১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। শুধু বিনিয়োগকারীই নন, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শেয়ার কেনাবেচায় জড়িত ব্রোকার হাউজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।

বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, ‘পুঁজিবাজার ভালো থাকবে’, ‘এখানে নিরাপদে বিনিয়োগ করুন’, ‘নিরাপত্তা আমাদের’- নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এমন আশ্বাসে সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করেছেন অনেকে। কমিশনের আশ্বাসে বিনিয়োগ করে গত এক বছরে যে মুনাফা হয়েছিল, গত তিন মাসের ধসে সেই মুনাফা চলে গিয়ে এখন কারো কারো মূলধন অর্ধেক হয়ে গেছে। কারো কারো তারচেয়েও কমে গেছে।

এই দরপতনের পেছনে যারা জড়িত তদন্ত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, পুঁজিবাজারকে এগিয়ে নিতে হবে, হারানো পুঁজি ফিরিয়ে দিতে হবে, বিনিয়োগকারীরা সে দাবি তুলেছেন।

ইউসিবি ক্যাপিটালের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী মোয়াজ্জেম কোরায়েশী বলেছেন, ব্যাংকের সুদ হার কম, তাই পরিবার নিয়ে ভালোভাবে চলতে পেনশনের ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি সঞ্চয়পত্রে। বাকি ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি পুঁজিবাজারে। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে প্রয়োজনের ১৫-২০ হাজার টাকা তুলে পরিবারের খরচও মিটিয়েছি। 

চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ছিল ৭ হাজার ৮৯ পয়েন্ট। এরপর থেকে চলা দরপতন ২৫ এপ্রিল বুধবার পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ফলে এই সময়ে সূচক ৯০১ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ১৮৮ পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে। কমেছে লেনদেন হওয়া প্রায় সব কোম্পানির শেয়ারের দাম। আর তাতে ১৫ লাখ ৫৪ হাজার বিনিয়োগকারীর বাজার মূলধন কমেছে ৬১ হাজার ৯৫১ কোটি ৯২ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এর মধ্যে সর্বশেষ ১১ দিনেই বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা।

গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া ধসের আগেও আমার ৩ লাখ টাকা লাভ ছিল। শেয়ারের দাম ছিল ১৮ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এখন সেই শেয়ারের দাম কমে মাত্র ১০ লাখ ১৩ হাজার ২২ টাকায় নেমেছে। তিন মাসে আমার ৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখন আমি কি করব? বলেন তিনি।

লঙ্কা বাংলা সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী আমান উল্লাহ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১০ সালের ধসের ক্ষতি পুষিয়ে কেবল লাভের মুখ দেখতে পেলাম। তারপর থেকে আবারও ধস নেমে এল। চলমান এই ধসে নতুন করে আমার ক্ষতি হয়েছে ৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।

তিনি বলেন, যারা পুঁজিবাজারে আবার ধস ডেকে এনেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। এই ধসে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হননি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমার মতো সাধারণ বিনিয়োগকারী।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের উত্থান নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির দ্বন্দ্ব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দাম বৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি এবং অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হতে পারে; এমন সব শঙ্কায় পুঁজিবাজারে দরপতন হচ্ছে। 

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ছিল ৭ হাজার ৮৯ পয়েন্ট। এরপর থেকে চলা দরপতন ২৫ এপ্রিল বুধবার পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ফলে এই সময়ে সূচক ৯০১ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ১৮৮ পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে। কমেছে লেনদেন হওয়া প্রায় সব কোম্পানির শেয়ারের দাম। আর তাতে ১৫ লাখ ৫৪ হাজার বিনিয়োগকারীর বাজার মূলধন কমেছে ৬১ হাজার ৯৫১ কোটি ৯২ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এর মধ্যে সর্বশেষ ১১ দিনেই বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে চলা দরপতন থেকে রক্ষা পেতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় হতে সব ব্যাংকগুলোতে চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এরপর শেয়ার কিনে মার্কেট সার্পোট দেওয়ার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবিকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকা আলাদা ফান্ডের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে। ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলেশন ফান্ড গঠন করেছে। এই ফান্ডের অর্থ আইসিবিরি মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, শেয়ারের দাম কমার সার্কিট ব্রেকার সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের বিধান থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়াও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে সম্প্রতি কারসাজি চক্রের বিষয়ে মাঠে নেমেছে কর্তৃপক্ষ। একজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী বেশি। তারা প্রকৃত কারণ না দেখেই গুজবে কান দেয়, ফলে একদিন দরপতন হলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, শেয়ার বিক্রি করা শুরু করেন।

তিনি বলেন, গুজবে কান দেওয়ার কারণে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের সময় থেকেই তারা শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেছেন। সেই ইস্যু শেষ না হতেই শ্রীলঙ্কার দেউলিয়ার ঘটনা প্রকাশের পর বাংলাদেশও দেউলিয়া হয়ে যাবে এই শঙ্কায় শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া শুরু করেছেন অনেকেই। তার তাতেই দরপতন প্রলম্বিত হচ্ছে। কমিশনার জানান, এসবের সঙ্গে আমাদের পুঁজিবাজারে কোনো সম্পর্ক নেই, তারপরও অযথা শেয়ার বিক্রি করে দরপতন ঘটাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি দরপতন ঠেকাতে।

বিএসইসির পাশাপাশি পুঁজিবাজারে চলমান ধস ঠেকাতে উদ্যোগ নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) মাধ্যমে ব্যাংকের বিনিয়োগকে পুঁজিবাজারে এক্সপোজার লিমিটের বাইরে রাখার নির্দেশ দেন। এছাড়াও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য আইসিবিকে দেওয়া ১৫০ কোটি টাকার তহবিলের মেয়াদ ও আকার বাড়ানোর নির্দেশ দেন।

নাম না প্রকাশ শর্তে ডিএসইর সাবেক এক পরিচালক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারের বড় সমস্যা হচ্ছে শেয়ারের দাম কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া। তিনি বলেন, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল এই দুই বছরে ২০১০ সালের চেয়ে বেশি কোম্পানিতে কারসাজি হয়েছে, কিন্তু কমিশন তাদের বিচার করেনি।

বরং তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে দেশ-বিদেশে রোড শো করে বেরিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগ আনবেন বলেন। তিনি বলেন, রোড শোতে বিদেশি বিনিয়োগ আসা তো দূরের কথা, গত এক দেড় বছরে উল্টো ১২ থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশিরা। বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন, আর তাতে প্রথমে দরপতন হয়েছে। এখন এই দরপতন ধসে রুপ নিয়েছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে গুজব সবসময় কাজ করে। সম্প্রতি এই গুজবে বেশি কান দিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কারণ গুজবে বলা হচ্ছে- সূচক আরও পড়বে ৪০০-৫০০ পয়েন্ট। এরপর বাজারে পতনও হচ্ছে। আর তাতেই বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেন।

এছাড়াও যেসব ব্রোকার হাউজে মার্জিন লোন রয়েছে, বাজার যখন খারাপ থাকে তারা শেয়ার বিক্রি করে সমন্বয় করে। ফলে ফোর্সসেল বেশি হয়, এটি রোধ করতে হবে।

তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের লোকসানের বড় কারণ হচ্ছে কারসাজি চক্রের দাপট। এই চক্রের কারণে ১০ টাকার শেয়ার ১০০ হয়ে যাচ্ছে, কয়েকজন মিলে দাম বাড়ানোর পর বিক্রি করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এই ফাঁদে পড়ে ফতুর হচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, বর্তমানে মার্কেটে প্রচুর পরিমাণে শেয়ারের সরবরাহ রয়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় চাহিদা কম। এখানে ২০১০ সালের পর থেকে যে শেয়ার বাজারে আসছে, এর মধ্যে ৯৯ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারই ভালো না। বাজারকে ভালো করতে হলে ভালো কোম্পানির শেয়ার তালিকাভুক্ত করতে হবে।

এ বিষয়ে ডিএসইর ব্রোকারর্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ডি রোজারিও ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর চেয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী বেশি। সুতরাং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্যানিক খুব দ্রুত কাজ করে। এটা পজেটিভ ও নেগেটিভ দুই দিকেই প্রভাব পড়ে। ফলে সূচক যখন বাড়ে অস্বাভাবিক হারে, আবার যখন কমে অস্বাভাবিক হারে কমে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই দরপতনের পেছনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দায় রয়েছে। তারা বাছ-বিচার না করেই হুজুগে শেয়ার কিনেছে। আবার যখন দাম কমতে থাকে তখন শেয়ার বিক্রি করে দেয়। যৌক্তিক নিয়ম হচ্ছে দাম কমলে অপেক্ষা করব, যখন দাম বাড়বে তখন বিক্রি করব। কিন্তু তারা উল্টো আচরণ করে।

ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বছরের শুরুতে দরতপন হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির দ্বন্দ্বের কারণে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বিনিয়োগের সীমা বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের সীমা গণনা করা হবে বাজার মূল্যের ভিক্তিতে। আর কমিশনের প্রস্তাব ছিল এক্সপোজার গণনা করা হবে শেয়ার কেনা মূল্যের ভিক্তিতে। একই বিষয়ে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা দুই রকম বক্তব্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে দরপতন শুরু হয়। এরপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব। তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডলারের বাজার অস্থিরতা ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির প্রভাব। এসব কারণে পুঁজিবাজারে দরপতন অব্যাহত রয়েছে।

এমআই/জেডএস