অর্থবছরের প্রথম মাস (জুলাই) জুড়েই ছিল পুঁজিবাজারে দরপতন। দরপতনের কারণে দেশের দুই বাজারেই (ডিএসই ও সিএসই) লেনদেন হওয়া সব শেয়ারের দাম কমেছে। শেয়ারের দাম কমায় সূচক কমে ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমেছিল। আরও দরপতন হতে পারে এ ভয়ে শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছেড়েছে ২ লাখ সাড়ে ১৯ হাজার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবধারী বিনিয়োগকারী।

ডলারের বাজারে অস্থিরতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারের অঞ্চলিক লোডশেডিং এবং জ্বালানি মজুদ নিয়ে নানা গুজবের কারণে জুলাই মাস জুড়ে দরপতন হয়েছে বলে মত এ খাতের বিশ্লেষকদের। আর এ দরপতনে পুঁজি হারিয়ে বাজার ছেড়েছেন বিনিয়োগকারীরা বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়টি স্বীকার করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে শুরু হয় রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দিয়েছে। জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতিতে বেড়েছে। বেড়েছে ডলারের দাম। ফলে সব কিছুই আমাদের পুঁজিবাজারে উপর ধাক্কা দিচ্ছে। তাতে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে। 

তিনি বলেন, বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করেছে টাকার মান কমে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে। এতে আমাদের কোনো হাত নেই।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) তথ্য মতে, জুনের তুলনায় জুলাই মাসে দেশি-বিদেশি এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মোট ২ লাখ ১৯ হাজার ৫৩৮টি বিও হিসাব কমেছে। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও কমেছে ২ লাখ ৮ হাজার ২৪৮টি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও কমেছে ১০ হাজার ৯১৯টি আর প্রাতষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিও কমেছে ৩৭১টি।

তথ্য অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ কর্মদিবস ৩০ জুন বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ২০ লাখ ৫৩ হাজার ৪২২টি। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও ছিল ১৯ লাখ ৬২ হাজার ৫৭টি। আর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও ছিল ৭৫ হাজার ১৮০টি এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিও ছিল ১৬ হাজার ১৮৫টি।

সেখান থেকে ২ লাখ সাড়ে ১৯ হাজার কমে ২০২২-২৩ সালের প্রথম মাস ৩১ জুলাই বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৪টিতে। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৫৩ হাজার ৮০৯টিতে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমে দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ২৬১টি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিও হিসাব কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৮১৪টি।

বাজার পরিস্থিতি
বিদায়ী মাসে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মোট ১৯ কর্মদিবস লেনদেন হয়েছে। এ ১৯ দিনের বেশিভাগ সময়ে সূচক কমেছে তাতে ডিএসইর প্রধান সূচক ২৪২ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৩৭৬ পয়েন্ট থেকে ৬ হাজার ১৩৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। তাতে বিনিয়োগকারীদের ১৪ হাজার ৯০৩ কোটি ৯৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ৩০ জুলাই ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৫ লাখ ১৭ হাজার ৭৮১ কোটি ৬৯ লাখ ১১ হাজার টাকা। সেখান থেকে কমে ৩১ জুলাই ছিল ৫ লাখ ২ হাজার ৮৭৭ কোটি ৭১ লাখ ৭৫ হাজার টাকার।

কেন কমেছে বিনিয়োগকারী
ডিএসইর সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে বিও হিসাবের নির্ধারিত বার্ষিক নবায়ন ফি পরিশোধ করতে হয়। ফি পরিশোধ না করার কিছু বিও হিসাব কমে কিন্তু এবার অনেক বেশি কমেছে। ডলারের বাজারের অস্থিরতা ও দেশের পুঁজিবাজারে দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে বলে জানান তিনি।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাথমকি গণপ্রস্তাব (আইপিও)র শেয়ার পেতে এখন বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের ৫০ হাজার টাকার বিনিয়োগ থাকতে হবে- এমন নিয়মের কারণে আইপিওতে আবেদনকারীদের সংখ্যা কমেছে।

এর আগের ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ থাকলেই আইপিওতে আবেদন করতে পারতো বিনিয়োগকারীরা। তিনি বলেন, এই আইন দিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আইপিওতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকৃত বিনিয়োগকারীরাই যাতে আইপিওর শেয়ার পায় সেই সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে যারা এতোদিন শুধু আইপিওর সঙ্গে জড়িত ছিল; একাই ১০০, ২০০ কিংবা ৫০০ বিও হিসাব ম্যানটেইন করত, তারা বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, এখন আর কেউ আত্মীয় স্বজন-বন্ধু-বান্ধবের নামে বিও খুলছে না। বিও অ্যাকাউন্টে স্বচ্ছতা বেড়েছে। প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার কারণে বিও হিসাব কমে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে নতুন করে প্রতিনিয়তই বিও বাড়ছে বলে জানান তিনি। 

উল্লেখ্য, নিয়ম অনুযায়ী একজন ব্যক্তি তার জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ফোন নম্বর ব্যবহার করে শুধুমাত্র একটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার লেনদেনের জন্য ডিপোজিটরি অংশগ্রহণকারীর মাধ্যমে সিডিবিএলের সঙ্গে একটি বিও অ্যাকাউন্ট খোলা বাধ্যতামূলক। বিএসইসি ২০১৬ সালে প্রতিটি বিও অ্যাকাউন্টের জন্য ৫০০ টাকা থেকে নবায়ন ফি কমিয়ে ৪৫০ টাকা করেছে।

এমআই/এসএম