ছয় বছর বন্ধ থাকার পর পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে পুঁজিবাবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জুট স্পিনার্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের আলোকে বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে উৎপাদন শুরু  হয়েছে।

বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন কোম্পানির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) তোফাজ্জাল হোসেন। তিনি বলেন, আজ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে। সফল হলে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে।

তিনি বলেন, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরুর লক্ষ্যে এরইমধ্যে তিনটি গোডাউনের মধ্যে কাঁচা পাটের দুটি গোডাউনের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। নতুন যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। আগের যন্ত্রপাতিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

এদিকে ‘পরীক্ষামূলক উৎপাদনে আসছে, শিগগিরই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আসবে’— এমন খবরে গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়ছে। ৫ সেপ্টেম্বর শেয়ারটির দাম ছিল ১৬০ টাকা ৮০ পয়সা। সেখান থেকে আটদিনে শেয়ার প্রতি ৬৬ টাকা ৯০ পয়সা বেড়ে আজ (বৃহস্পতিবার) লেনদেন হয়েছে ২২৭ টাকা ৭০ পয়সা দরে। অর্থাৎ ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনী কোম্পানির বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি ৬৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

কোম্পানিটির ১৭ লাখ শেয়ারের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৬০ দশমিক ১৮ শতাংশ। বাকি ৩৯ দশমিক ৮২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে।

মালিকানা দ্বন্দ্ব, ব্যবসায় লোকসানের পাশাপাশি নগদ অর্থ সংকট ও পাওনাদারদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থতাসহ ঋণের ভারে জর্জরিত জুট স্পিনার্স লিমিটেডের উৎপাদন বন্ধ হয় ২০১৬ সালের জুন মাসে। কোম্পানির অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পৌনে ২ কোটি টাকার কোম্পানির ব্যাংক ঋণ ৪৯ কোটি টাকা! এর সঙ্গে গত এক দশকে কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান ২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোম্পানির সম্পদের চেয়ে লোকসান অনেক বেশি।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, জুট স্পিনার্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ শামস-উল হকের মৃত্যু হয় ২০১০ সালে। এরপর থেকে তার ছেলেরা কারখানাসহ সম্পদের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। শামস-উল হকের মৃত্যুর প্রথম দুই বছর পর অর্থাৎ ২০১২ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। এরপর থেকে ব্যাংকের ঋণ বৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রমিক জটিলতায় লোকসানে নিমজ্জিত হয় কোম্পানিটি। এক পর্যায়ে চালাতে না পেরে ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। 

জুট স্পিনার্স লিমিটেডের সার্বিক অবস্থা

কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট লোকসান হয়েছে সাত কোটি ৫৮ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) তিন প্রান্তিকে লোকসান আরও বেড়েছে। এ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের অনিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুসারে, শেয়ারপ্রতি কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ১০ টাকা ৮৩ পয়সা। শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদের মূল্য ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪৬ টাকা ৭ পয়সায়।

কোম্পানির ঋণ

১৯৮৪ সালে তালিকাভুক্ত এক কোটি ৭০ লাখ টাকার কোম্পানিটির ৪৯ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ রয়েছে। তবে, ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেখানো হয়েছে ৪০ কোটি ৬৮ লাখ ছয় হাজার টাকার ঋণ। এর মধ্যে ৩১ কোটি ৭৭ লাখ ছয় হাজার টাকা স্বল্পমেয়াদি, আট কোটি ৯১ লাখ টাকার ঋণ দীর্ঘমেয়াদি। এ ঋণের সঙ্গে কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান ২৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ঋণ ও লোকসান মিলে কোম্পানির কাছে পাওনা ৭৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে কোম্পানির সম্পদের মধ্যে রয়েছে ১০ দশমিক ২০ একর জমি, কারখানা ও মেশিন।

নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ

২০১৬ সালের অডিট প্রতিবেদনে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান শফিক বসাক অ্যান্ড কোম্পানি দেখিয়েছে, শ্রমিক জটিলতা, পাওনাদারদের টাকা পরিশোধে অক্ষমতা এবং ম্যানেজমেন্টের দুর্বলতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত জুট স্পিনার্স।  আন্তর্জাতিক হিসাব মান (আইএএস)-৩৬ অনুযায়ী প্রতি বছর কোম্পানির সম্পদ মূল্যায়ন শেষে ইমপেয়ারমেন্ট টেস্ট বাধ্যতামূলক (যদি থাকে)। পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ প্রতিষ্ঠানটির। ফলে আর্থিক বিবরণীতে সম্পদের প্রকৃত বাজারদরে পার্থক্য হওয়াটা স্বাভাবিক। এরপরও কর্তৃপক্ষ ইমপেয়ারমেন্ট টেস্ট (বৈকল্য পরীক্ষা) করেনি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি কোনো প্রকার রেজুলেশন ছাড়াই এমডির কাছ থেকে দুই কোটি ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এমডি ছাড়াও পরিচালক মুহাম্মদ শামস-উল-কাদিরের স্ত্রী আয়েশা কবিরের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের ৩৫ লাখ টাকা এখনো পরিশোধ করা হয়নি। কিন্তু সেই অর্থের ওপর গত পাঁচ বছরের জন্য ২২ লাখ ৭৫ হাজার টাকার সুদ ধরা হয়েছে। এভাবে জুট স্পিনার্স কর্তৃপক্ষ কোম্পানি আইন ও ইনকাম ট্যাক্স অধ্যাদেশ ভঙ্গ করে পরিচালকদের সঙ্গে অধিকাংশ লেনদেন নগদে করেছে।

এমআই/আরএইচ