ওষুধ খাতের প্রতিষ্ঠান নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের শেয়ার বরাদ্দের আগেই কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। রোববার (২ অক্টোবর) আবেদনকারীদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হবে। তার আগেই শেয়ার বাজার ও আইপিও কেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে বরাদ্দে কারসাজির তথ্য দিয়ে। 

তাদের অভিযোগ, কারসাজি করে এ শেয়ারে আবেদন বেশি দেখানো হয়েছে। এর আগে অন্য কোনো শেয়ারের ক্ষেত্রে এতো আবেদন পড়েনি। আর বেশি আবেদন দেখানোর কারণে, একজন দেশি বিনিয়োগকারী পাবেন ৪৫-৪৬টি শেয়ার, আর প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা পাবেন ১৮৮-১৮৯টি করে শেয়ার। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বাজার থেকে মোট ৭৫ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। 

শেয়ার বরাদ্দ দেওয়ার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রতিনিধি, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) এবং কোম্পানির প্রতিনিধি থাকবেন। অনুষ্ঠানে প্রবাসী-দেশি, প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দ করা শেয়ার সমানভাবে ভাগ করা করে দেওয়া হবে।

শেয়ার বরাদ্দের তথ্য আগেভাগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় নাভানা ফার্মার দেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারী ক্যাটাগরিতে কারসাজি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিভিন্ন গ্রুপে দেওয়া স্ট্যাটাসে উল্লেখ রা হয়েছে, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বিএসইসির কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ব্রোকার হাউজের কর্মকর্তারা আইপিও আবেদনে কারসাজি করছে। প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের এতো আবেদন জমা হতেই পারে না। ব্রোকার হাউজগুলো বিনিয়োগকারীদের বন্ধ কিংবা সাসপেন্ড হওয়া বিওতে আইপিও এপ্লাই করছে এবং সিরিয়াল ট্রেডিং করছে। যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত তা সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানানো হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত এমডি সাইফুর রহমান মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাভানা ফার্মানিউটিক্যালসের আইপিও বরাদ্দের তথ্যই এখনও প্রকাশ হয়নি। সুতরাং কারসাজি হবে কীভাবে? তারপরও বিষয়টি খতি দেখা হবে।

নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএসইর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়ম অনুসারে রোববার আবেদনকারীদের মধ্যে শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হবে। কোন ক্যাটাগরির বিনিয়োগকারীরা কয়টি করে শেয়ার বরাদ্দ পাবে এটা গোপন তথ্য। এই তথ্য আগামীকাল প্রকাশ করা হবে।

তিনি বলেন, নির্ধারিত তারিখের আগে যেসব বিওতে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ ছিল না। সেই সব বিও থেকে আইপিওতে আবেদনের কোনো সুযোগ নেই। কারণ এগুলো সিডিবিএল ব্লক করে দিয়েছে। আমি কারসাজি হওয়ার কোনো সুযোগ দেখছি না।

বিনিয়োগবকারেদের মধ্যে শেয়ার বরাদ্দের তথ্য আগেরই ফাঁস হয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আপনি যে তথ্য দেখিয়েছেন। সেই তথ্য কীভাবে পেল সেটা চিন্তার বিষয়। এই গোপন তথ্য কারা প্রকাশ করেছে সেটা জানা খুবই জরুরি।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করসাজি হলে খুঁজে বের করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিনিয়োগকারীদের যত অভিযোগ
ফেসবুকের ‘IPO Gainer & Share Business Group’ গ্রুপে আব্দুল্লাহ আল মামুন নামের এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, পুঁজিবাজারে বিভিন্ন হাউজে যে-সব বিও বন্ধ করে দিয়েছে গ্রাহক, কিংবা বিও সাসপেন্ড হয়ে গেছে। হাউজ থেকে সব বিও-তে আইপিও এপ্লাই করা হচ্ছে এবং সিরিয়াল ট্রেডিং করা হচ্ছে। এটা তদন্ত করে দেখা হোক। সেইসঙ্গে ইনস্টিটিউট কোটা ২-৫ শতাংশ এর মধ্যে নিয়ে আসা হোক।

IPO SUCCESS GROUP গ্রুপে আইয়ুব খান অভিযোগ করেন, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালের বিষয়ে তদন্তের জন্য আইপিও গ্রুপের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন জানানোর অনুরোধ করছি।

স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন, নাভানার এর আইপিও বরাদ্দে অবশ্যই দুর্নীতি হয়েছে। এতগুলো বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধের পরও কীভাবে এত এপ্লাই হয়েছে। এটা তদন্ত করলে অনেক কিছু বের হয়ে আসবে। সবাই মিলে কিছু একটা করা উচিত।

একই গ্রুপে মোহাম্মদ ইলিয়াছ কামাল নামে একজন কমেন্টস করেছেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। অথবা কোথাও ভুল হয়েছে। এনআরবি আবেদন ২ লাখ, বড়জোর আড়াই লাখ এর চেয়ে বেশি হতেই পারে না।’

দুটি স্ট্যাটাসের কমেন্টস বক্সে, আবদুল্লা আল মামুন নামে একজন অভিযোগ করেন, আমার মনে হচ্ছে কিছু অসাধু ব্রোকারেজ হাউস নির্ধারিত ৫০ হাজার টাকার শেয়ার বাই না করেও অ্যাপ্লিকেশন করেছে। এটা তদন্তের দাবি রাখে। কোনো কারচুপি হয়েছে কিনা, শেয়ার বরাদ্দের আগে যাচাই-বাছাই করা দরকার। এমনও তো হতে পারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৫০ হাজার টাকা শেয়ার না কিনে শুধু ১০ হাজার টাকা আইপিওর জন্য জমা দিয়েছে!

শাহেদ মিয়া নামে আরেকজন অভিযোগ করেন, আমার হাউজের মালিকের কোডে কোটি কোটি শেয়ার আছে, বিভিন্ন কোডে জাস্ট ট্রান্সফার!

তার উত্তরে মামুন বলেন, সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিধি-বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত ৫০ হাজার টাকার শেয়ার বাই না করে যদি কোনো ব্রোকারেজ হাউজ আইপিওর জন্য এপ্লাই করে ওই হাউজের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। শেয়ার বরাদ্দের আগে প্রত্যেকটি বিও অ্যাকাউন্টের পোর্টফোলিও চেক করা দরকার।

জামাল হোসেন স্ট্যাটাস অভিযোগ করেন, নাভানা ফার্মার আইপিওতে ভ্যালিড সবগুলো অ্যাকাউন্টে কাট অফ ডেটে ৫০ হাজার টাকার শেয়ার ছিল কি না তা যাচাই করলেই থলের বিড়াল বের হয়ে আসবে।

আহসান হাবিব অভিযোগ করেন, ‘নাভানা আইপিও তে অবশ্যই দুর্নীতি হয়েছে, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হোক’।

অর্নব নামে একজন অভিযোগ করেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থার লোকজন যদি শেয়ার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে তখন কারসাজির কোনো লিমিট থাকে না। আসলে আমাদের উচিত এই বাজার ছেড়ে অন্য কোনো ছোটখাটো ব্যবসায় বিনিয়োগ করা, রক্ষক যদি ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তবে সেখানে আমাদের পুঁজি আজ অথবা কাল নিঃশেষ হয়ে যাবে।

এছাড়াও এম ইসলাম উদ্দীন নামে একজন স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন, ‘নাভানা ফার্মা শেয়ার বরাদ্দে কারসাজির গন্ধ পাচ্ছি’। 

এইভাবে একের পর এক বিনিয়োগকারী ফেসবুকে নাভানা ফার্মার শেয়ার বরাদ্দে কারসাজি হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন। আর বরাদ্দ বাতিল চাচ্ছেন।

উল্লেখ্য, নাভানা ফার্মার শেয়ারের কাট-অফ প্রাইস নির্ধারিত হওয়ার পর গত ১৩ সেপ্টেম্বর আইপিওতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আবেদন গ্রহণ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯ সেপ্টেম্বর।

সাধারণ বিনিয়োগকারী অর্থাৎ দেশি বিনিয়োগকারী ও অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে মোট ১ কোটি ৭৩ লাখ ৭ হাজার ৭০০টি শেয়ার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই শেয়ার বরাদ্দ দেওয়ার জন্য আইপিওতে আবেদন গ্রহণ করা হয়। এতে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৫৪৭টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারী ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪২৮টি আবেদন জমা পড়ে। যার শেয়ার সংখ্যা ১৪ কোটি ৭০ লাখ ২৬ হাজার ৪৮টি। তাতে টাকার অংকে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৫৩ কোটি ৪২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

অপরদিকে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব থেকে আবেদন করা হয়েছে ৬ হাজার ১১৯টি। যার শেয়ার সংখ্যা ২৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫০৪টি। টাকার অংকে যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ১১ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

প্রাতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং যোগ্য বিনিয়োগকারীসহ মোট ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯২১টি শেয়ারে আবেদনের বিপরীতে ১৭ কোটি ৯৭ লাখ ২৩ হাজার ৬৮৯টি শেয়ার কেনার আবেদন জমা পড়েছে। যা বরাদ্দের চেয়ে ৬ দশমিক ১৫ গুণ বেশি। বরাদ্দ ছিল ২ কোটি ৭১ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৪টি শেয়ার। যা টাকার অংকে ছিল ৭৫ কোটি টাকা। সেই টাকার শেয়ারের জন্য ৪৬১ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ২৫৮ টাকার জমা পড়েছে।

এর আগে গত ৪ থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত সময়ে আইপিওর বিডিংয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা অংশগ্রহণ করে। তারা কোম্পানির শেয়ারের কাট-অফ প্রাইস ৩৩ টাকা ৯৭ পয়সা নির্ধারণ করে।

নিয়ম অনুসারে, সেই কাট-অফ প্রাইসের ওপর ৩০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি জন্য দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা।

চলতি বছর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসকে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৭৫ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয়। এই টাকা কোম্পানিটি নতুন ভবন নির্মাণ, ইউটিলিটি ও ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন নির্মাণ, সেফালোস্ফোরিন ইউনিটের সংস্কার, ঋণ পরিশোধ এবং আইপিওর ব্যয় বাবদ খরচ করবে।

এক্ষেত্রে কোম্পানিকে শর্ত দেওয়া হয়েছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির আগে কোম্পানিটি কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে না। কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে আনতে ইস্যু ম্যানেজারের কাজ করছে এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্স ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও ইবিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

কোম্পানির তথ্য মতে, গত ১ জুলাই ২০২১ থেকে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ২ টাকা ৩৯ পয়সা। গত ৫ বছরে কর-পরবর্তী মুনাফার ভারিত গড় হারে ইপিএস হয়েছে ২ টাকা ৫১ পয়সা।

একই সময়ে পুনর্মূল্যায়ন ছাড়া কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) ছিল ১৯ টাকা ০২ পয়সা। আর পুনর্মূল্যায়ন পরবর্তী মূল্য ছিল ৪৩ টাকা ৫৩ পয়সা।

এমআই/