বছরজুড়ে উত্থান–পতনের মধ্যে পার হয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এ বাজার স্বাভাবিক মনে হয়নি। এ কারণে গেল বছর কেনার চেয়ে প্রায় তিনগুণ শেয়ার বিক্রি করেছেন তারা। বিদেশি বিনিয়োগের সব কটি সূচক নামে নেতিবাচক ধারায়।

২০২২ সালে বিদেশিরা এক হাজার ১৫৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকার শেয়ার কেনেন। বিপরীতে তিন হাজার ২৫ কোটি ১৮ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেন। অর্থাৎ প্রায় তিনগুণ বেশি শেয়ার বিক্রি করেন।

গত ৩১ ডিসেম্বর দেশের প্রধান পুঁজিবাজার  ডিএসইতে মোট লেনদেনের মাত্র ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ এসেছে বিদেশিদের শেয়ার কেনাবেচা থেকে। এছাড়া পুঁজিবাজার আরও খারাপ হতে পারে এই ভয়ে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করেই ক্ষান্ত হননি, অন্তত ২৩ হাজার বিও অ্যাকাউন্টধারী (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) পুঁজিবাজার ছেড়েছেন।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভালো কোম্পানির অভাব, শেয়ারের দাম অতি মূল্যায়নের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে  বৈশ্বিক অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। এছাড়া বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো হচ্ছে— এমন খবরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে দেশে সুদের হার বৃদ্ধি, মার্কিন (ইউএস) ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং পুঁজিবাজারে ঘন ঘন নীতি পরিবর্তনের কারণে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন।

অপরদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট-এর প্রতিবেদন বলছে, জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২২ সময়ের মধ্যে পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার বিক্রি করে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীরা। এরপর রয়েছেন যথাক্রমে লুক্সেমবার্গ, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কানাডা, মরিশাস, পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিনিয়োগকারীরা।

এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক ও সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশিরা দেখেশুনে বিনিয়োগ করেন। লাভ না হলে তারা কখনও বিনিয়োগ করেন না। এখন শেয়ারের দাম কম তাই বিনিয়োগ করছেন। শেয়ারের দাম বাড়লে বিক্রি করে দেবেন।

‘গত চার বছরের মধ্যে প্রথম বছর দরপতন ও করোনার কারণে শেয়ার বিক্রি করেন তারা (বিদেশিরা)। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছর যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে বেশি দাম বাড়ায় শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নেন তারা। চতুর্থ বছর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে ডলারের বাজার ছিল অস্থির। ফলে ছিল ডলারের সংকট। অন্যদিকে, ফ্লোর প্রাইস আরোপসহ নানা ইস্যুতে টালমাটাল ছিল দেশের পুঁজিবাজার। এসব কারণে বিদেশিরা পুঁজি হারানোর ভয়ে শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নেন।’

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা যায়নি। সুশাসনের অভাব তো রয়েছে। এসব কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা কম।’

বিদেশি বিনিয়োগ কমার বিষয়টি স্বীকার করেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডলারের রেট যখন বেড়ে যায় তখন বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে প্রফিট তুলে নেন। এখন ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট স্ট্যাবল হয়ে নিচের দিকে নামছে। তারা এখন বিনিয়োগ করছে।

যেভাবে কমে ২৩ হাজার বিও অ্যাকাউন্টধারী

শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর সময়ে এক লাখ ৭৩ হাজার ৯৮টি বিও অ্যাকাউন্ট কমেছে। এর মধ্যে বিদেশিদের ২৩ হাজার ২৪৪টি। 

২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও ছিল ৮৬ হাজার ৩৬১টি। সেখান থেকে ২৩ হাজার ২৪৪টি কমে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ১১৭টি।

গত দুই বছরে বিদেশিদের বিনিয়োগের খতিয়ান

২০২২ সালে ডিএসইতে দেশি-বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের লেনদেন হয়েছে দুই লাখ ৩৪ হাজার ৩০০ কোটি ২১ লাখ ২০ হাজার টাকার শেয়ার। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট কেনা-বেচাবাবদ লেনদেন হয়েছে মাত্র চার হাজার ১৭৯ কোটি ৯২ লাখ ২৭ হাজার ৬৯৩ টাকার, অর্থাৎ পৌনে ২ শতাংশ। এর মধ্যে ২০২২ সালে এক হাজার ১৫৪ কোটি ৭৪ লাখ ২৬ হাজার ২৫০ টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে বিদেশিরা বিক্রি করেছেন তিন হাজার ২৫ কোটি ১৮ লাখ এক হাজার ৪৪৩ টাকার শেয়ার। অর্থাৎ টাকার অঙ্কে গত বছরে বিদেশিরা এক হাজার ৮৭০ কোটি ৪৩ লাখ ৭৫ হাজার ১৯৩ টাকা তুলে নিয়েছেন অর্থাৎ নিট বিনিয়োগ কমেছে।

২০২১ সালে ডিএসইতে মোট তিন লাখ ৫৩ হাজার ৯৭৮ কোটি ৬১ লাখ ৯০ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার লেনদেন হয়েছিল সাত হাজার ৭৬৪ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ৭৪৫ টাকার শেয়ার। ওই বছর দুই হাজার ৫৫৮ কোটি এক লাখ ১১ হাজার ৮২৩ টাকার শেয়ারের বিপরীতে পাঁচ হাজার ২০৬ কোটি ২০ লাখ ৫৮ হাজার ৯২১ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছিল। অর্থাৎ শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি বেশি করেছিলেন বিদেশিরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

গত ৩০ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশিরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন মাত্র ২১ কোটি ১২ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। এর বিপরীতে ৪০ কোটি ৭৭ লাখ ডলারের সমপরিমাণ টাকার শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ তুলে নেন। ফলে নিট বিনিয়োগ কমে ১৯ কোটি ৬৪ লাখ ডলার।

এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ কমে আরও বেশি। ওই বছর প্রায় ৪১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ টাকা তুলে নেন বিদেশিরা। বিদেশিরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন ৩৪ কোটি ৫৯ লাখ ডলার, বিপরীতে বিক্রি করেন ৭৫ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের সমপরিমাণ শেয়ার।

এছাড়া করোনার সময় অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদেশিরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছিল ৩৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, আর বিক্রি করেছিল ৪৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। ওই বছর বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ কমেছিল ১৪ কোটি ৫১ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আগস্টে বিদেশিদের পোর্টফোলিও বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৮৬ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়। বিপরীতে ৬৬৮ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ জুলাই মাসের তুলনায় আগস্ট মাসে বিদেশিরা নিট বিনিয়োগ কমে ৫৮২ কোটি টাকার শেয়ার। জুলাই মাসে নিট বিক্রি ছিল ১৩৯ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ফরেন ইনভেস্টররা শেয়ার বিক্রি করে দেন। বাংলাদেশেও এটি হয়েছে। বিদেশিরা যখন দেখলেন ডলারের দাম বাড়তি তখন তারা বিক্রি করে দেন। পরবর্তীতে যখন দেখলেন ডলার কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে এসেছে, পাশাপাশি পুঁজিবাজারের ফ্লোর প্রাইস উঠছে না; তখন তারা বিনিয়োগ শুরু করে দিলেন।

‘ফ্লোর প্রাইস নিয়ে তাদের ধারণা ছিল বিভিন্ন চাপে এটা উঠে যাবে। এরপর তারা (বিদেশিরা) রেগুলেটরদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছে যে ফ্লোর প্রাইস উঠছে না। এটি উঠে গেলে বিদেশিরা আরও দেরিতে মার্কেটে ফিরতেন। যখন তারা দেখলেন ফ্লোর আপাতত উঠার সম্ভাবনা নেই তখনই তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হলেন।’

এমআই/এমএআর/