১৫৮ কোটি টাকা নয়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি ইউনিভার্সাল ফিন্যান্সিয়াল সলিউশন্স লিমিটেডের (ইউএফএসএল) চার মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগকারীদের ২৩৫ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির এমডি সৈয়দ হামজা আলমগীর কাগজপত্র জাল করাসহ বিভিন্ন কৌশলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ইউএফএসএল নিয়ন্ত্রিত চারটি মিউচুয়াল ফান্ড হলো— ইউএফএস-ব্যাংক এশিয়া ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস-আইবিবিএল শরিয়াহ ইউনিট, ইউএফএস-পদ্মা লাইফ ইসলামিক ইউনিট ফান্ড এবং ইউএফএস-পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড। ২০১৮ সাল থেকে ইউএফএসএলের ফান্ড থেকে অর্থ সরানো শুরু করে এমডি সৈয়দ হামজা আলমগীরের নেতৃত্বে একটি চক্র। এই চার ফান্ডের বিনিয়োগকারীদের অর্থ নিয়ে আলমগীর বর্তমানে দুবাই অবস্থান করছেন।

এমডির চক্রটি ব্যাংকের প্রতিবেদন জালিয়াতি এবং ভুয়া এফডিআরের (ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট) মাধ্যমে এ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ জেনে-বুঝেও চার বছর ধরে নিষ্ক্রিয় ছিল ফান্ডের ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান (গ্যারান্টি দেওয়া প্রতিষ্ঠান) আইসিবি। এ অপকর্মকে বৈধতা দিয়েছে দুই অডিট কোম্পানি আহমেদ জাকের অ্যান্ড কোম্পানি এবং রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। অপরদিকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিছুই জানত না।

চলতি বছরের শুরুতে ‘শেয়ারবাজারে ইউএফএস নজিরবিহীন কেলেঙ্কারি, ১৫৮ কোটি টাকা নিয়ে দুবাই পালিয়েছে এমডি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর বিএসইসির কাছে ব্যাখ্যা চান হাইকোর্ট। তার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩৫ কোটি টাকা লোপাটের তথ্য পায় বিএসইসি। এর মধ্যে ১৭০ কোটি টাকারও বেশি বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

বিএসইর তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, ইউএফএসএলের এমডি আট লাখ টাকার চারটি এফডিআর করেন। এরপর ব্যাংকের নথিতে কারসাজি করে আমানতের অঙ্ক দেখিয়েছেন ৪৯ কোটি। এমডির চক্রটি নিজের অথবা নিজের আত্মীয়-স্বজনদের প্রতিষ্ঠানে টাকা স্থানান্তর করেন। এছাড়া ১০ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকার ব্যবস্থাপক ফি নেওয়া হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

২০১০ সালে সম্পদ ব্যবস্থাপকের সনদ পাওয়া ইউএফএসএল ৪৩০ কোটি টাকার সাতটি মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনা করত। লোপাটের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির অডিট ফার্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অডিট ফার্মটি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড তদারকির দায়িত্বে ছিল। এছাড়া ইউনিভার্সাল ফিন্যান্সিয়াল সলিউশন্সের অধীন মিউচুয়াল ফান্ডগুলোয় তাদের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দুটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে বিএসইসি।

বিএসইসির তদন্তে দেখা যায়, ইউএফএসএল বিনিয়োগের কাগজপত্রে জালিয়াতি করে ২০১৬ এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনটি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে প্রায় ৫৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ছয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এই ছয় প্রতিষ্ঠানই ইউএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তার সহযোগীদের মালিকানাধীন।

বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউএফএসএলের ২৩৫ কোটি টাকা লোপাট করে ১৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা টাকার পাচার করেছে ইউএফএসএলের এমডি। এর মধ্যে ৫৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা পাচার করেছে বিনিয়োগের নামে বাণিজ্যিক নথিপত্র জাল করে আর ৪৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা পাচার করেছে ভুয়া এফডিআরের মাধ্যমে। এছাড়া ৬৩ কোটি টাকা নিবন্ধিত সিকিউরিটিজের শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভুয়া বিনিয়োগ ও ভুয়া এফডিআর থেকে ফান্ডগুলোকে ‍সুদ দেওয়া হয়নি। তাতে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয়েছে ৫৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, উল্টো ফান্ডগুলোর নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি) বেশি দেখিয়ে ট্রাস্টি, কাস্টডিয়ান ও সম্পদ ব্যবস্থাপকদের কাছ থেকে আরও ৫ কোটি ৮২ কোটি টাকা রিফান্ড নেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত চার্জ হিসেবে। ইউএফএসএল প্রত্যেক প্রান্তিকে কমিশন, ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ানের কাছে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বছর শেষে ভুয়া ব্যাংক ব্যালেন্স জমা দিয়েছে। কিন্তু অডিটর সেটা যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন মনে করেনি।

এমডি আলমগীর প্রাথমিকভাবে চারটি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ইউএফএসএলের ব্যাংক হিসাবে টাকা স্থানান্তর করেন। এরপর তিনি নিজের সহযোগী ও তাদের কোম্পানিতে কিছু তহবিল স্থানান্তর করার সময় স্থানান্তরিত অর্থের বড় অংশ তুলে নেন।

ইউএফএসএলের ফান্ডের অর্থ ভ্যানগার্ড ট্রেডার্স, তানজিনা ফ্যাশন, আরআই এন্টারপ্রাইজ, নেত্রকোনা এক্সেসরিজ, মাল্টিম্যাক্স ইন্টারন্যাশনাল, স্কেপটার কমোডিটিস, নিটওয়্যার ক্রিয়েটর, ম্যাক্স সিকিউর এবং মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকীর ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তদন্ত কমিটির পরামর্শ

ইউএফএসএল কী পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করেছে বা সিকিউরিটিজ কেনা-বেচা থেকে কী পরিমাণ প্রকৃত লাভ তুলে নিয়েছে— তা নির্ধারণ করতে পারেনি তদন্ত কমিটি। এ তথ্য উদঘাটনের জন্য একটি বিশেষ নিরীক্ষা (স্পেশাল অডিট) করার পরামর্শ দিয়েছে তদন্ত কমিটি।

এছাড়া, ফান্ড থেকে স্থানান্তরিত অর্থের কারসাজির পদ্ধতি আরও ভালোভাবে জানতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের অধীনে আরও তদন্ত করা যেতে পারে। এতে বলা হয়, ইউএফএসএল অ্যাকাউন্ট খোলার পর থেকে মোট ২২৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর এর ব্যালান্স ছিল মাত্র ৪ হাজার ১৭৮ টাকা। এই সময়ে এর ইক্যুইটি মূলধন ছিল মাত্র ১১ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

এ ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। এ প্রতিষ্ঠানে আইসিবির বিনিয়োগ ছিল ৪৮ কোটি টাকা, যা উদ্ধার করা এখন প্রায় অনিশ্চিত। চারটি মিউচুয়াল ফান্ডের ট্রাস্টি এবং তত্ত্বাবধায়ক ইউএফএসএলের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে। এর মধ্যে একটি মামলা অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার তদন্ত হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তিনি বলেন, কমিশন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে কাজ করছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে যখন যা প্রয়োজন আইন অনুসারে তাই করা হবে। যারা এর পেছনে রয়েছে সবাইকে আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমআই/এসএসএইচ/