গেল বছর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ঊর্ধ্বমুখী পুঁজিবাজারে হঠাৎ শুরু হয় দরপতন। এই দরপতনের হাত থেকে বিনিয়োগকারীদের বাঁচাতে ২০২২ সালে ২৮ জুলাই বাজারে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর আগে ২০২০ সালে প্রথম ফ্লোর প্রাইস দিয়েছিল বিএসইসি।

তারপর ৯ মাস পেরিয়েছে। এসময়ে বিএসইসিকে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দিতে চাপ দিয়েছে ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংকের মালিকরা। বিএসইসিও একবার ১৬৯টি কোম্পানির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাজারে তাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি, বরং ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেওয়া কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রতিনিয়ত কমছিল। তাই তড়িঘড়ি করে বিএসইসি সেসব কোম্পানিতে আবারও ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে।

এদিকে, ফ্লোর প্রাইস আরোপের কারণে লেনদেনে খরায় পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। গত ৬-৭ মাস আগেও যেখানে দিনে ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, সেই বাজারে এখন লেনদেন হচ্ছে ৪-৫শ কোটি টাকা। লেনদেন কমে যাওয়ায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ব্রোকার হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় ফ্লোর প্রাইস নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিকল্পনা কী– জানতে চাওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কাছে।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে তিনি সাফ জানিয়েছেন, বিএসইসি এই মুহূর্তে ফ্লোর প্রাইস উঠাবে না। শেয়ার কেনা-বেচা করে ফ্লোর প্রাইস উঠাবে ইনভেস্টররাই (বিনিয়োগকারীরা)।

আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান বাজার কেমন? জবাবে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, পুঁজিবাজার আরও ভালো ও গতিশীল হতে পারত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সবাই তো আশা করে বিএসইসি বাজারের সব করে দেবে। বাজার ভালো করার দায়িত্ব কি একা বিএসইসির, কারও কি কোনো কিছু করার নেই।

আরও পড়ুন : আত্মসাৎ হওয়া মিউচুয়াল ফান্ডের ২৩৫ কোটি টাকা ফেরত দেবে ইউএফএস

ফ্লোর প্রাইসের প্রসঙ্গ টেনে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ফ্লোর প্রাইসও না কি আমি ‍তুলে দেব? তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে চলমান দরপতন ঠেকাতে আমি তো ফ্লোর প্রাইস দিয়েছি, যাতে বাজারে ফোর্স সেল না হয়। ফোর্স সেলের কারণে মানুষের সব টাকা-পয়সা চলে যায়। কিছু মানুষের লাভের জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে যাবে– তা আমি হতে দিতে পারি না। এতে গুনাহও হবে।

শিবলী রুবাইয়াত বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা যাতে নিঃস্ব না হয়, সুরক্ষা পায়, সেজন্য ফ্লোর প্রাইস দিয়েছি। আমি তো উঠাব না, বিএসইসিও না, এই ফ্লোর প্রাইস উঠাবে ইনভেস্টররা (বিনিয়োগকারী)। বিনিয়োগকারীরা কেনা-বেচা করলেই উঠে যাবে।

তিনি বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে হয়ত অনেকের ব্যবসা হচ্ছে না। আরও কেনা-বেচা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু ইউক্রেন ‍যুদ্ধের সময় বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার দিতে হবে। এটা প্রত্যেকের সমস্যা, সারা পৃথিবী এখন টালমাটাল, আমি গভর্নরকে নিয়ে বাজারটা ধরে রেখেছি। বাজারটা উপরে উঠতে না পারলেও যেন পড়ে না যায়।

‘এই যুদ্ধের কারণে সারা পৃথিবী সমস্যার মুখে পড়েছে। এটা তো সারা পৃথিবীই সামাল দিতে পারছে না। বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকার পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় আমরা বাজারটাকে ধরে রেখেছি।’

ফ্লোর প্রাইস নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী– এমন প্রশ্নের জবাবে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ইতোমধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অর্ধেকের বেশির শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস উঠে গেছে। বাকি কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে, এগুলো তো উনারাই কেনা-বেচা করে উঠিয়ে ফেলতে পারেন।

‘তারপরও পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট দূর করতে ক্যাপিটাল মার্কেট স্টাবিলাইজেশন ফান্ড থেকে মার্চেন্ট ব্যাংক ব্রোকারদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। বন্ডগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের এক্সপোজার থেকে বাইরে রাখা হয়েছে, যা আগামী ৯ এপ্রিল জাতীয় সংসদে পাস হবে। পুঁজিবাজারের স্বার্থে আরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’

তিনি বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারের সূচক ৬ হাজার ২০০ পয়েন্টে অবস্থান করছে। এই উদ্যোগের ফলে সেখান থেকে যদি সূচক ৩০০-৫০০ পয়েন্ট বাড়ে, তার প্রভাবে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার বেড়ে যাবে। আমার কাছে যদি মনে হয়, পুঁজিবাজার ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সুরক্ষিত থাকবে, তখনই ফ্লোর তুলে নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে হয়ত তখনো ১০-২০টি কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসের নিচে থাকবে। তারপরও ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হবে। কারণ এগুলো দুর্বল কোম্পানি, সারা পৃথিবীজুড়েই দুর্বল কোম্পানি থাকবে।

আরও পড়ুন : অ্যাংকর সিকিউরিটিজের গ্রাহকের হিসাবে কোটি টাকা ঘাটতি, পেলো শাস্তি

শিবলী রুবাইয়াত বলেন, এক কথায় যখন দেখব ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে মানুষগুলো বাঁচবে, মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তখনই তুলে নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আসলে আমিও ফ্লোর প্রাইস চাই না। কিন্তু আমি বাধ্য হচ্ছি মানুষকে বাঁচানোর জন্য। ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে অনেকে নিঃস্ব হয়ে যাবে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগে দেশের পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ছিল ৭ হাজার ৩৬৭ পয়েন্ট। এরপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে সূচক কমতে শুরু করে। ফলে গত বছরের ২৮ জুলাই পর্যন্ত সময়ে ডিএসইর সূচক প্রায় ১৪শ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯৮০ পয়েন্টে দাঁড়ায়।

নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাজারের এই দরপতন ঠেকাতে ২০২২ সালে ২৮ জুলাই ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে। ফ্লোর প্রাইস আরোপের পরপরই বাড়তে শুরু করে সূচক। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ৬০০ পয়েন্ট বেড়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সূচক ৬ হাজার ৬০০ পয়েন্টে দাঁড়ায়। তারপর নেতিবাচক প্রভাবে কমতে শুরু করে।

১৯ সেপ্টেম্বর যেখানে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার কোটি টাকা। সেই বাজারে গত বছরের ডিসেম্বর লেনদেন কমে চলে আসে ২০০ কোটি টাকার কোটায়। বাজারকে এ অবস্থা থেকে উত্তোলনে ১৬৯টি কোম্পানির শেয়ারে ২১ ডিসেম্বর ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয় বিএসইসি। এরপর লেনদেন কিছুটা বাড়লেও প্রতিনিয়ত কমতে থাকে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম। ফলে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে আবারও ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

এরপর থেকে ব্রোকার হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক এবং অর্থনীতিবিদসহ পুঁজিবাজারের বড় একটি অংশ ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেয় বিএসইসিকে। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কথা চিন্তা করে ফ্লোরের নিয়মই বহাল রেখেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

ডিএসইর তথ্য মতে, ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ডিএসইতে ফ্লোর প্রাইস ছিল ২৭৩টি কোম্পানির শেয়ারে। তার আগের দিন ছিল ২৭১টি কোম্পানির শেয়ারে, তার আগের দিন ৩ এপ্রিল ফ্লোর প্রাইসে ছিল ২৬৫টি।

তার আগের দিন অর্থাৎ ২ এপ্রিল ফ্লোর প্রাইস ছিল ২৫৯টি কোম্পানির শেয়ারে। অর্থাৎ প্রতিনিয়তই ফ্লোর প্রাইসে থাকা কোম্পানির সংখ্যা বাড়ছে।

এমআই/এসএসএইচ/