এপেক্সের চেয়ে ‘বেশি লাভ’ নিয়েও লোকসানে বাটা!
দেশের ব্র্যান্ডের জুতার বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে শীর্ষস্থানীয় দুই ব্র্যান্ড এপেক্স ও বাটা। সারাদেশে ব্র্যান্ড জুতার চাহিদার অর্ধেকের বেশি মেটায় এই দুই ব্র্যান্ড। অবশ্য, সাম্প্রতিক সময়ে বাটার চেয়ে এপেক্সের বাজার আধিপত্য বেড়েছে। একদিকে বাটার বাজার পরিধি ছোট হচ্ছে, অন্যদিকে কোম্পানিটি ধীরে ধীরে লোকসানের পথে হাঁটছে।
জুতা বিক্রিতে এপেক্সের তুলনায় বাটা বেশি হারে লাভ নিয়েও কোম্পানিটি বিভিন্ন খরচের ভারে ঝুঁকছে। উৎপাদন খরচ বিবেচনায় চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এপেক্সের তুলনায় বাটা শতকরা ১১ টাকা হারে বেশি লাভ নিয়েছে। অথচ, আলোচিত সময়ে এপেক্সমুনাফা করলেও বাটার হয়েছে বড় লোকসান।
বিজ্ঞাপন
উৎপাদন খরচ বিবেচনায় দেশের বাজারে যতগুলো জুতার ব্র্যান্ড রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাভ নেয় বাটা শু। বিগত প্রায় অর্ধযুগের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি ১০০ টাকার জুতা বিক্রিতে বাটা সর্বনিম্ন ২৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৮ টাকা পর্যন্ত সরাসরি লাভ নিয়েছে। যেখানে এপেক্সের সরাসরি লাভ নিয়েছে সর্বনিম্ন ২৭ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা পর্যন্ত। অন্যান্য কোম্পানির সরাসরি লাভের হার আরও কম। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরও কয়েকটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেগুলোর সরাসরি লাভের হার ১৫ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে রয়েছে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের প্রতি ১০০ টাকা বিক্রির বিপরীতে সরাসরি লাভ হয়েছে ২৭ টাকা ১৪ পয়সা। অন্যদিকে, তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি বাটা শু তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রতি ১০০ টাকা বিক্রির বিপরীতে সরাসরি লাভ নিয়েছে ৩৮ টাকা ৪৪ পয়সা
সরাসরি লাভ বলতে, মোট বিক্রয় মূল্য থেকে উৎপাদন সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয় বাদ দিয়ে যা থাকে সেটি বোঝানো হয়েছে। উৎপাদন খাতের কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে সরাসরি লাভ-কে ‘গ্রস প্রফিট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারখানার শ্রমিকদের বেতন, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানিসহ অন্যান্য ব্যয় এবং পণ্য উৎপাদনের জন্য কারখানায় হওয়া সমগ্র ব্যয় বাদ দিয়ে গ্রস প্রফিট বা সরাসরি লাভ বের করা হয়। এর বাইরে কোম্পানির দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়, বিভিন্ন ধরনের আর্থিক খরচ, সঞ্চিতি গঠন এবং কর সংক্রান্ত ব্যয় বহন শেষে নিট মুনাফা বা লোকসানের হিসাব করা হয়।
বিজ্ঞাপন
ব্র্যান্ডের জুতার বাজারে এপেক্স ও বাটার অবস্থান কেমন
ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি রুচির পরিবর্তন ও মানের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হওয়ায় ব্র্যান্ডের জুতার প্রতি ঝুঁকছে দেশের মানুষ। সেজন্য ব্র্যান্ডের জুতার বিক্রি প্রতি বছর ১২-১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। তাই নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় নামছে। তবে, ব্র্যান্ডের জুতার ব্যবসায় শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে এপেক্স, বাটা ও লোটো। এর মধ্যে এপেক্স ও বাটা দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় কোম্পানি দুটি নিয়মিত তাদের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যানুযায়ী, দেশে বার্ষিক জুতার চাহিদা ২০ থেকে ২৫ কোটি জোড়া। চাহিদার ৪০ শতাংশ জুতা বিদেশ থেকে আমদানি হয়। সারা দেশে ছোট-বড় ছয় হাজার ২০০ জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের কারখানা রয়েছে। তার মধ্যে আড়াই হাজার জুতা তৈরির কারখানা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্থানীয় বাজারের ৩০ শতাংশ ব্র্যান্ডের জুতার দখলে। বাকিটা নন-ব্র্যান্ড, আঞ্চলিক ব্র্যান্ড ও আমদানি করা জুতার দখলে। আগে জুতার ব্যবসা উৎসবকেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে সারা বছর কম-বেশি জুতা বিক্রি হয়। তারপরও সারা বছরের বিক্রির ২৫-৩০ শতাংশই হয়ে থাকে ঈদুল ফিতরে।
১০০ টাকার জুতা বিক্রিতে এপেক্স ও বাটা কে কত লাভ পায়
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের প্রতি ১০০ টাকা বিক্রির বিপরীতে সরাসরি লাভ হয়েছে ২৭ টাকা ১৪ পয়সা। কোম্পানিটি এখনো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পূর্ণাঙ্গ আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। আগের অর্থবছরে ১০০ টাকা বিক্রির বিপরীতে সরাসরি লাভ করেছিল ৩০ টাকা ৩২ পয়সা। এছাড়া, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শতকরা ২৬ টাকা ৮৩ পয়সা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৮ টাকা ৬২ পয়সা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৯ টাকা ১০ পয়সা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৮ টাকা ৬২ পয়সা সরাসরি লাভ করেছে।
গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাটা শু-র জুতা বিক্রি বাড়লেও অন্যান্য খাত থেকে প্রাপ্ত আয়ে ভাটা পড়েছে। এ সময়ে কোম্পানির বিকল্প আয় খাতে লোকসান হয়েছে পাঁচ কোটি টাকার বেশি, পরিচালন ব্যয় বেড়েছে আরও পাঁচ কোটি টাকার মতো এবং জমাকৃত অর্থের বিপরীতে সুদ আয় কমেছে। এতে সার্বিকভাবে কোম্পানিটিকে ১৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে
অন্যদিকে, তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি বাটা শু তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রতি ১০০ টাকা বিক্রির বিপরীতে সরাসরি লাভ নিয়েছে ৩৮ টাকা ৪৪ পয়সা। ২০২৪ সালে কোম্পানিটি বিক্রি থেকে শতকরা ৪৭ টাকা ১৭ পয়সা হারে সরাসরি লাভ নিয়েছিল। এর আগের বছরে নিয়েছে ৪৫ টাকা ৯২ পয়সা। এছাড়া, ২০২২ সালে ৪৩ টাকা ৭২ পয়সা, ২০২১ সালে ৩৬ টাকা ৩৯ পয়সা এবং ২০২০ সালে ২৪ টাকা ৮৭ পয়সা সরাসরি লাভ নিয়েছে কোম্পানিটি।
বিক্রিতে বেশি লাভ নিয়েও লোকসানে বাটা
চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাটা শু-র মোট বিক্রি হয়েছে ১৮৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩০ কোটি ৫ লাখ টাকা বেশি। এই বিক্রি থেকে উৎপাদন খরচ বাদে কোম্পানির সরাসরি লাভ হয়েছে ৭০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এই লাভ শতকরা হিসাবে ৩৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ বা প্রতি ১০০ টাকায় ৩৮ টাকা ৪৪ পয়সা। লাভের এই হার আলোচ্য সময়ে এপেক্সের লাভের হারের চেয়ে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ বা ১১ টাকা ৩০ পয়সা বেশি। তা সত্ত্বেও আলোচ্য সময়ে বাটা শু-র নিট লোকসান হয়েছে ১৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। একদিকে পণ্যে সরাসরি লাভ বেশি নেওয়া, অন্যদিকে বিক্রির পরিমাণ বাড়ার পরও আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটিকে এই বড় পরিমাণ লোকসান গুনতে হলো।
লোকসানের কারণ জানতে বাটা শু-র একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক। কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) ইলিয়াস আহমেদকে মুঠোফোনে ফোন দেওয়ার পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এছাড়া, কোম্পানি সেক্রেটারি রিয়াজুর রেজা মুহাম্মাদ ফয়সাল কর্মব্যস্ততা দেখিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এপেক্স ফুটওয়্যারের মোট বিক্রি হয়েছে ৪৮৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এই বিক্রি থেকে কোম্পানিটি সরাসরি লাভ পেয়েছে ১১৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। তবে, আলোচিত সময়ে অন্যান্য ব্যয় বহন শেষে কোম্পানির নিট মুনাফা হয়েছে মাত্র দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই মুনাফা গত বছরের একই সময়ের দুই কোটি ৮৩ লাখ টাকার চেয়ে ৩৩ লাখ টাকা কম
তবে, কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাটা শু-র জুতা বিক্রি বাড়লেও অন্যান্য খাত থেকে প্রাপ্ত আয়ে ভাটা পড়েছে। এ সময়ে কোম্পানির বিকল্প আয় খাতে লোকসান হয়েছে পাঁচ কোটি টাকার বেশি, পরিচালন ব্যয় বেড়েছে আরও পাঁচ কোটি টাকার মতো এবং জমাকৃত অর্থের বিপরীতে সুদ আয় কমেছে। এতে সার্বিকভাবে কোম্পানিটিকে ১৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।
আগের পাঁচ বছরের মধ্যে তিন বছর সামান্য মুনাফা হলেও দুই বছর লোকসান গুনতে হয়েছে বাটা শু-কে। এর মধ্যে ২০২০ ও ২০২১ সালে যথাক্রমে ১৩৩ কোটি ও সাত কোটি টাকা নিট লোকসান হয়েছিল। আর ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে যথাক্রমে ৪১ কোটি, ৪০ কোটি ও ৩০ কোটি টাকা নিট মুনাফা হয়েছে।
মুনাফা কমেছে এপেক্স ফুটওয়্যারেও
অন্যদিকে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এপেক্স ফুটওয়্যারের মোট বিক্রি হয়েছে ৪৮৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এই বিক্রি থেকে কোম্পানিটি সরাসরি লাভ পেয়েছে ১১৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। তবে, আলোচিত সময়ে অন্যান্য ব্যয় বহন শেষে কোম্পানির নিট মুনাফা হয়েছে মাত্র দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই মুনাফা গত বছরের একই সময়ের দুই কোটি ৮৩ লাখ টাকার চেয়ে ৩৩ লাখ টাকা কম।
আলোচ্য সময়েএপেক্স ফুটওয়্যারের মুনাফা কমার কারণ জানতে চাইলে কোম্পানি সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘মূলত দুটি কারণে ব্যবসায় ভালো করার পরও আমাদের মুনাফা কমে গেছে। প্রথমত, করের পরিমাণ বেড়েছে। চলতি বছরের বাজেটে করহার বৃদ্ধির কারণে এ বাবদ খরচ গত বছরের তুলনায় বেড়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকঋণের সুদহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বাবদ খরচও বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে কোম্পানির মুনাফায়।’
লোকসানের কারণ জানতে বাটা শু-র একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক। কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) ইলিয়াস আহমেদকে মুঠোফোনে ফোন দেওয়ার পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এছাড়া, কোম্পানি সেক্রেটারি রিয়াজুর রেজা মুহাম্মাদ ফয়সাল কর্মব্যস্ততা দেখিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন
কোম্পানিটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছে। তার আগের অর্থবছরে নিট মুনাফা হয়েছিল ১৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এছাড়া, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৬ কোটি ৭১ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ কোটি ৮২ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ কোটি ৫৩ লাখ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছয় কোটি ৩২ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছিল।
১০০ টাকার জুতা বিক্রিতে অন্য কোম্পানিগুলো কেমন লাভ নেয়
প্রতি ১০০ টাকার জুতা বিক্রিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৪ টাকা ৪১ পয়সা হারে সরাসরি লাভ নিয়েছে লিগ্যাসি ফুটওয়্যার। আগের অর্থবছরে কোম্পানিটির ১৭ টাকা ৭২ পয়সা হারে সরাসরি লাভ নিয়েছিল। এম কে ফুটওয়্যার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিক্রি মূল্যের শতকরা ২৩ টাকা ৯৬ পয়সা হারে সরাসরি লাভ নিয়েছে। আগের অর্থবছরে নিয়েছিল ১৪ টাকা ৩২ পয়সা হারে। এছাড়া, ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতি ১০০ টাকার জুতা বিক্রিতে ১৪ টাকা ৪০ পয়সা হারে সরাসরি লাভ নিয়েছে। আগের অর্থবছরে কোম্পানিটি ১৭ টাকা ৬ পয়সা হারে সরাসরি লাভ নিয়েছিল।
এমএমএইচ/এমএআর