ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে রাত-দুপুরে লাইন ধরতে রাখা হয় ব্যাগ

রাত তখন ১২টা ছুঁই ছুঁই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনের রাস্তা দিয়ে ক্রিং ক্রিং শব্দে এগিয়ে এলো একটি সাইকেল। গ্রন্থাগারের প্রবেশমুখে এসেই ব্রেক কষলেন সাইকেল চালক। এরপর গ্রন্থাগারের সামনের ফাঁকা জায়গায় ব্যাগ রাখলেন।

তাকে দেখে এগিয়ে এলেন আগে থেকে সেখানে অবস্থান নেওয়া ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদক। পরিচয় দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করতেই কিছুটা ইতস্তত বোধ তার। জানালেন, পরিচয় জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই ট্রল করবে, এই ভয়ে নাম প্রকাশ করতে চান না। আলাপচারিতায় জানা গেল, তিনি বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থী, পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগে। ধরে নিলাম তার নাম সাব্বির আহমেদ।

এত রাতে এখানে কেন? এমন প্রশ্ন করতেই কিছুটা কাঁচুমাচু করছিলেন। অভয় দিতেই গভীর রাতে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে আসার ও ব্যাগ রাখার হেতু জানা গেল। 

সাব্বির বলেন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রবেশের জন্য সবসময়ই লাইন ধরতে হয়। এই লাইন মৌসুমভেদে ছোট-বড় হয়। করোনার আগে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রবেশে ছেলেদের লাইন ডাকসু ভবন পর্যন্ত যেত। আর মেয়েদের লাইন থাকত অনেক ছোট। ৪০-৫০ জনের মতো ছাত্রী লাইন ধরতেন।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে দেড় বছর বন্ধ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধ ছিল চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাও। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গত বছরের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে পাঠদান শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাগুলোরও সার্কুলার হতে থাকে। আবার আটকে থাকা নিয়োগ পরীক্ষারও নতুন তারিখ ঘোষণা হয়। এরই মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। বছরের সাধারণত মার্চ-এপ্রিলের দিকে শিক্ষার্থীদের মিডটার্ম পরীক্ষা হয়ে থাকে। আবার করোনার কারণে কিছু বিভাগের আটকে থাকা সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা হচ্ছে এখন। ফলে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের চাপ বেড়েছে।

‘আগে ভোর ৬টার দিকে লাইনে দাঁড়ালে ৩০-৪০ জনের পেছনে থাকতাম। আর এখন এলে ৩০০-৪০০ জনের পেছনে দাঁড়াতে হয়। আটটায় গ্রন্থাগারে প্রবেশের আগ পর্যন্ত গ্রন্থাগারের সামনে থেকে শুরু হওয়া লাইন ডাকসু, কলাভবন ছাড়িয়ে আবার ইউ (U) আকৃতিতে লাইব্রেরি পর্যন্ত আসে। মেয়েদের লাইন যায় ডাকসু ভবন পর্যন্ত। তাই গভীর রাতে এসে ব্যাগ রাখতে হচ্ছে। এ এক অসম প্রতিযোগিতা সেটা আমি জানি, কিন্তু গ্রন্থাগারে পড়ার সুযোগ কে না চায় বলুন!’ – যোগ করেন তিনি। 

সাব্বিরের সাথে কথা বলা শেষ হতে না হতেই সাইকেল নিয়ে এলেন আরেক শিক্ষার্থী। তিনি দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করা মাস্টারদা সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থী মাহমুদ আলম (ছদ্মনাম)। তার আগমনের হেতুও একই, ব্যাগ রেখে গ্রন্থাগারে প্রবেশের জন্য লাইন ধরা।

মাহমুদ আলম জানান, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে এর আগেও পড়ার জন্য বহুবার এসেছেন। তবে এখন আর আগের সময়ের মধ্যে অনেক তফাৎ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার কারণে হঠাৎ করেই কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীদের চাপ বেড়েছে বলে জানান তিনি।

মাহমুদ বলেন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের নিচ তলা থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরেই স্থায়ীভাবে নিজের পছন্দের সিটে প্রতিদিনই বসতে চান শিক্ষার্থীরা। দেরি করে এলে পছন্দের জায়গা না পাওয়ার শঙ্কা থাকে। তাই অনেকেই আগে আগে চলে আসেন। আগে ফজরের নামাজ পড়ে লাইনে দাঁড়াতাম। কিন্তু এখন রাত ১২টার সময়ই আসতে হচ্ছে। কারণ, আমাদের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে আসন সংখ্যা চাহিদার তুলনায় কম। আবার পরীক্ষার মৌসুমগুলোতে শিক্ষার্থীদের বেশ চাপ থাকে।

‘প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের কিছু শিক্ষার্থী আছেন, যারা সকালবেলা গ্রন্থাগারে আসেন। কিছুক্ষণ থেকে এরপর ক্লাসে যান, হলে যান, আড্ডা দেন কিন্তু সারাদিন আর গ্রন্থাগারে ঢুকেন না। তাদের কারণে অনেক শিক্ষার্থী গ্রন্থাগারে আসন পায় না। আবার প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষেরই অনেক শিক্ষার্থী চাকরির পরীক্ষার পড়াশোনাও করেন, এটাও কৃত্রিম আসন সংকটের জন্য দায়ী।’ – যোগ করেন তিনি।
 
তিনি বলেন, আমরাও চাই না গভীর রাতে এসে লাইন ধরতে। শিক্ষার্থীদের লাইন মনিটরিং করা যায়। কিন্তু কথা হলো, এই মনিটরিং করবে কে! শিক্ষার্থীরা মনিটরিং করলে দেখা যাবে লাইন ধরার সিন্ডিকেট তৈরি হবে। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার কমপ্লেক্স করা হবে শুনেছি। কিন্তু সেটা কবে হবে জানি না। এই সমস্যার সমাধানে প্রশাসনকেই এগিয়ে আসতে হবে।

মাহমুদ আরও বলেন, অনেক বহিরাগতও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে পড়তে আসেন। চেক করার উপায় কী! আইডি কার্ড পাঞ্চ করে প্রবেশের যে নিয়ম, সেটি কিছুদিন চালু ছিল। কেন তা বন্ধ হলো জানি না। সেই পদ্ধতি আবার চালু হলে বহিরাগত শিক্ষার্থী প্রবেশ রোধ করা যাবে।

তিনি আরও বলেন, সাবজেক্ট রিলেটেড জব যেহেতু খুবই সামান্য, তাই স্নাতকোত্তরের পরপরই সরকারি চাকরি পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আহ্বান থাকবে, গ্রন্থাগারে প্রবেশের ডিজিটাল কার্ড তৈরি করুন এবং সেই কার্ডে স্নাতকোত্তর শেষ করা শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে মেয়াদ অন্তত দুই বছর বাড়িয়ে দিন।

সাব্বির ও মাহমুদের মতো আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী রাতের বেলায়ই ব্যাগ রাখতে এলেন। এরপর ছবি তুলে রাখলেন যাতে অন্য কেউ মাঝখানে ব্যাগ না রাখতে পারে। আলাপচারিতায় তারাও একই সমস্যা, অভিযোগ ও দাবি জানিয়েছেন। রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে ব্যাগ রেখে লাইন ধরেছেন আরও অন্তত ২০ জন।

তাদের মধ্যে অনেকেই নিজের ব্যাগের মধ্যে পুরে পাটের আরও ৫-৬টি ব্যাগ নিয়ে এসেছেন। সেসব ব্যাগ কেন রাখা হচ্ছে জানতে চাইলে তারা কোনো উত্তর দেননি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ব্যাগ দিয়ে বন্ধুদের জন্য লাইন ধরেন তারা। সেসব বন্ধু সকাল সাতটা বা তারও পরে এসে ব্যাগ অনুসারে লাইনে দাঁড়ান। গভীর রাতে যারা ব্যাগ রাখতে আসেন, তাদের কেউই রাত জেগে ব্যাগ পাহারা দেন না। লাইব্রেরি খোলার আগ মুহূর্তে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে যান। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক ড. মো. নাসিরুদ্দিন মুন্সী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষার্থীরা চাইলে সকালে এসেও লাইন ধরতে পারে। কিন্তু তারা রাতের বেলায় লাইন ধরে নিজের আসন নিশ্চিত করার জন্য। চাহিদার তুলনায় লাইব্রেরিতে আসন কম। তাই এই মুহূর্তে আমরা কিছু করতে পারছি না।

গ্রন্থাগারে বহিরাগতদের প্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এর দায় শিক্ষার্থীদের দিলেন। তিনি বলেন, বহিরাগত কেউ এসে থাকলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কোনো শিক্ষার্থীর বন্ধু বা আত্মীয়। আমরা বলেছি, বহিরাগত চিহ্নিত করে জানাতে। সেটাও তো তারা করে না। শুধু অভিযোগই দেন। তবে বহিরাগত চিহ্নিত করতে মাঝেমধ্যেই তারা গ্রন্থাগার পরিদর্শনে যান বলে জানান তিনি।

ঢাবি গ্রন্থাগারিক বলেন, আমরা পাঞ্চ কার্ড সিস্টেম চালু করেছিলাম। কিন্তু শিক্ষার্থীরাই সেটি সাদরে গ্রহণ করেনি। পাঞ্চ কার্ড দিয়ে প্রবেশ করতে সময় বেশি লাগে এমন অভিযোগে তারা গ্রন্থাগারের কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেছে।

তিনি আরও বলেন, গ্রন্থাগার কমপ্লেক্সের ঘোষণা এলেও এখনো তা একনেকে ঝুলে আছে। কবে নাগাদ পাস হবে, তাও বলতে পারছি না। এই কমপ্লেক্স হয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের চাপ কমবে।

এ বিষয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। 

এএজে/এইচকে