এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে বয়সের জটিলতা দেখা দিয়েছে ৩৫ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষকদের ক্ষেত্রে। এতে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েও তিন মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না তারা। এ সুযোগে জটিলতা নিরসনে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঘুষ চাচ্ছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী শিক্ষকদের। তবে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, তাদের পরিচয় ব্যবহার করে ঘুষ নিতে একটি চক্র সক্রিয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ৩৫ বছরের বেশি বয়সী নতুন শিক্ষকদের বয়স নিয়ে জটিলতা থাকায় যারা এমপিওভুক্ত হতে পারছেন না, তাদের কাছে ঘুষ চেয়ে কল করা হচ্ছে। সম্প্রতি বয়স বেশি দেখিয়ে এমপিও আবেদন বাতিল করা হয়েছে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের জয়নারায়ণপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার প্রভাষক (ইংরেজি) মো. হাবিবুর রহমানের। কয়েকদিন আগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের সেলফোনে কল দিয়ে এমপিওভুক্তির জন্য ঘুষ দাবি করা হয়।

এ বিষয়ে হাবিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার রিজেকশন বৈধ নয় উল্লেখ করে বেতন প্রদানের জন্য অনুরোধ করে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর একটি আবেদন করেছিলাম। এরপরই অধিদপ্তরের মেমিস প্রজেক্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার হারুন অর রশীদ পরিচয়ে আমার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কাছে কল আসে। আমার এমপিও আবেদন বাতিলের বিষয়ে অধ্যক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হয়। পরবর্তীতে আমি কল দিলে তিনি ২৫ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন।

তবে, ঘুষ চাওয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মেমিস প্রজেক্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার হারুন অর রশীদ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, অপরিচিত নম্বর থেকে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নাম করে টাকা দাবি করা হচ্ছে। আমার নাম বলেও প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা দাবি করছে চক্রটি। তারা এখন খুবই সক্রিয়। আমরা সতর্ক আছি; প্রার্থীদেরও বলব, তারাও যেন এসব ফোনকলে বিশ্বাস না করেন।

জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কে এম রুহুল আমিন বলেন, কে বা কারা এটি করছে সেটি আমাদের জানা নেই। আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ আসলে বিষয়টি বিবেচনা করব।

ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ আসার পর গত কয়েকদিনে ০১৭৭৪৮৭৫৪৬০ নম্বরে কল দেওয়া হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

জানা গেছে, এনটিআরসিএ কর্তৃক নিয়োগ চক্রের তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির ৪নং শর্ত অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারির পূর্বে আবেদনকারীর বয়স ৩৫ বছর বা তার কম হতে হবে। তবে, শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ইনডেক্সধারী প্রার্থী এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৩৯০০/২০১৯ মামলার রায় অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১২ জুনের আগে যারা শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ লাভ করেছেন তাদের ক্ষেত্রে বয়স শিথিলযোগ্য।

তবে, জনবল কাঠামো-২০২১ এর ১১.১১ ধারা অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর। ইতোমধ্যে ৩৫ বছরের বেশি বয়সী প্রার্থী যাদের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা সাংঘর্ষিক হওয়ায় এমপিও প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে হাবিবুর রহমান বলেন, বয়স বেশি দেখিয়ে আমার এমপিও আবেদন রিজেক্ট করা হয়েছে। কিন্তু গণবিজ্ঞপ্তির চতুর্থ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের নীতিমালা জারির আগে যারা পাস করেছে (১-১৩তম নিবন্ধন), তারা বয়সের আওতায় আসবে না। আমি নবম নিবন্ধনের। আজ থেকে এক বছর আগে আমাদের থেকে টাকা ও আবেদন নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বয়সের বিষয়টি এখন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আনা হয়েছে, যা দুর্ভাগ্যজনক।

তিনি বলেন, আমার তিন সন্তানের মধ্যে দুই মেয়েই অনার্স পড়ে। তিন মাস বেতন পাই না। ধারদেনা করে চলছি। এভাবে কতদিন চলা যায়!

‘গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবেদন করেছি এবং সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর এখন বয়সের বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে। তাহলে আমাকে চাকরি দিল কেন? আমার নিয়োগ বৈধ হলে বেতন কেন হবে না?’

ঘুষ দাবি করে শিক্ষক হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তির অডিও রেকর্ড ঢাকা পোস্টের কাছে আছে। কথোপকথন হুবহু তুলে ধরা হলো-

হারুন নামধারী ব্যক্তি : আপনি কি এনটিআরসিএ-তে অ্যাপ্লিকেশন করে গিয়েছিলেন?

হাবিবুর রহমান : না

হারুন নামধারী ব্যক্তি : জাস্ট আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে একটা দরখাস্ত জমা দিয়ে গেছেন?

হাবিবুর রহমান : ডাকে পাঠিয়েছি। আমার ফাইল তো রিজেক্ট করেছে বয়সের কারণ দেখিয়ে। এক বছর আগে আমাদের থেকে আবেদন নেওয়া হয়েছে। সরকার আমাদের বলেছে আবেদন করার জন্য, আমরা আবেদন করেছি। এখন আমরা বেতন পাব না, এটা তো হতে পারে না। 

হারুন নামধারী ব্যক্তি : আমি যেগুলো বলতেছি সেগুলো একটু শুনেন। টাকা দেওয়া হবে কি হবে না সেটা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানবে। আমাদের তো বলে লাভ নেই। এনটিআরসিএ থেকে যদি তালিকা না পাঠায় আমরা আপনাদের কীভাবে টাকা দেব? আপনি এনটিআরসিএ- এর কাছে কোনো দরখাস্ত জমা দেননিই, এই তো?

হাবিবুর রহমান : না, না। আমি এনটিআরসিএ তে কোনো অভিযোগ দিইনি। কারণ, এখানে তো আমরা সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে যোগদান করেছি। প্রত্যাশা করিনি যে, আমাদের বেতন দেওয়া হবে না। সরকার আমাদের নিয়োগ দিয়েছে।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : সরকার নিয়োগ দিয়েছে, সরকারই এটা আবার সমাধান করবে, সমস্যা কী?

হাবিবুর রহমান : শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি অধিদপ্তরকে নির্দেশনা না দেয়, আমরা বেতন পাব না। এটা তো আমরা জানতাম না।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : এক মিনিট শুনেন, আমি শর্টকাটে কথা বলি। হাতে কাজ আছে। সেটা হলো- এনটিআরসিএ-র কাছে যারা দরখাস্ত করেছিল গত মাসে সেখান থেকে ৩২টি ফাইল আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। এ কারণে আপনাকে কল দিয়েছি, এনটিআরসিএ-র কাছে দরখাস্ত করেছেন কি না?

হাবিবুর রহমান : আপনি যদি আমাকে পরামর্শ দেন দরখাস্ত দিতে, আমি দিতে পারি। আমি তো এই বিষয়গুলো জানি না।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : আপনি জানেন না, এখন আপনার জন্য তো আমরা মিটিং আটকে রাখতে পারব না।

হাবিবুর রহমান : আমি এখন কী করতে পারি? আমার দুইটা মেয়ে অনার্সে পড়ে। আমার চাকরির ওপরেই সবাই নির্ভরশীল। কিন্তু দুই মাস হলো আমি বেতন পাচ্ছি না। আমি কীভাবে কী করব? 

হারুন নামধারী ব্যক্তি : আপনি আগে দরখাস্ত করলে হয়ত সেন্ট্রাল প্রোগ্রামারের সাথে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। এখন তো কিছু করারও নেই।

হাবিবুর রহমান : আমাকে বলেন, যে নির্দেশনা দেন আমি ফলো করব।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : আপনি ফলো করবেন কীভাবে? আপনি থাকলে না সেন্ট্রাল প্রোগ্রামারকে বলে একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। না থাকলে ফোনে ফোনে সব কথা তো আর বলাও যাবে না। যাবে?

হাবিবুর রহমান : মানে, আমাকে ঢাকায় আসতে হবে?

হারুন নামধারী ব্যক্তি : আপনি এনটিআরসিএ-র থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত না?

হাবিবুর রহমান : জি।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান বরাবর দরখাস্ত করলে তারা যদি তা অ্যাপ্রুভ করে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়, আমরা এটি ইয়ে করব। আমরা বারবার তালিকা দিতে বলেছি। কিন্তু তারা আমাদের সুনির্দিষ্ট কোনো তালিকা দিতে পারছে না।

হাবিবুর রহমান : এনটিআরসিএ বরাবর দরখাস্ত দিলে এটা এই মাসে হবে?

হারুন নামধারী ব্যক্তি : এ মাসে কীভাবে হবে, আপনার ফাইলই তো নিচ্ছে না, নাকি?

হাবিবুর রহমান : আমরা আবেদন করেছি, সেটা ফরোয়ার্ড করেনি।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : এখন দেখেন এর পরের মাসে, এ মাসে কীভাবে করবেন? যদি আগে বলতেন, এনটিআরসিএ থেকে যে ৩২টা ফাইল আসছে, সেগুলো অ্যাপ্রুভ হয়ে যাবে। সার্ভার থেকে আমরা অটোমেটিক্যালি অ্যাপ্রুভ করে দেব।

হাবিবুর রহমান : এই মাসে করার জন্য কোনো ওয়ে আছে কি না, থাকলে আমাকে একটু বলুন, প্লিজ।

হারুন নামধারী ব্যক্তি: আপনি থাকলে তো আমি একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। সেন্ট্রাল প্রোগ্রামার স্যারের সাথে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করা যেত। আপনি নেই, আমি কীভাবে করব?

হাবিবুর রহমান : এখন তো অনলাইনের যুগ, আমাকে সেভাবে একটু সহযোগিতা করুন। আমার আবেদনগুলো পাঠিয়ে দেই।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : আপনার আবেদন অনলাইনে পাঠিয়ে দিলে অ্যাক্সেপ্ট করবে? করবে না।

হাবিবুর রহমান : আমি আসতেছি, হয়তো একটা অ্যাডভানস কপি দিলাম। আমাকে প্লিজ হেল্প করুন।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি। শুনেন, আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার বলছিলাম হারুন অর রশীদ চৌধুরী, মেমিস থেকে। এটা আপনারা আগে যোগাযোগ করলে হয়ত আমরা একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। আপনার বয়স দেখলাম তো অনেক হয়ে গেছে।

হাবিবুর রহমান : জি, এখন আমার ৪৯ বছর চলতেছে।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : কারণ, এখানে আসলে দেখা যাচ্ছে প্রোগ্রামার স্যারের সাথে কথা বললে উনার কোনো দায়-দাবি থাকলে আপনি কথা বলে যে স্যার আমি গরিব মানুষ, আমাকে একটু এটা থেকে মুক্তি দেন। তাহলে ওই মাসের বেতনটা চলে যেত।

হাবিবুর রহমান : স্যার, আপনি একটু হেল্প করুন। আপনি যদি বলেন, আমি এখনই বাসে করে চলে আসব।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : আপনি থাকলে প্রোগ্রামার স্যারের কোনো কথা থাকলে বলতে পারতেন। এছাড়া আমি আপনার ফাইল যদি নিয়েও যাই, তিনি অ্যাপ্রুভ করবেন না।

হাবিবুর রহমান : আমি চাকরিতে যোগদান করেছি, বেতন পাওয়াটাই আমার প্রত্যাশা। এখন লোকালে থেকে আমরা তো জানি না কোথায় যোগাযোগ করতে হবে। আমরা তো শুরু থেকে প্রোপার ওয়ে তে আবেদন পাঠাচ্ছি আর রিজেক্ট হচ্ছে। আপনি আমাকে একটু হেল্প করেন, স্যার আমি আপনার সাথে দেখা করব। আপনি একজন প্রোগ্রামার।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার।

হাবিবুর রহমান : জি, ওখানে যারা আছেন, সবাই আপনার কলিগ। আপনি একটা কথা বললে তারা রাখবেন। আপনি আমাকে একটু হেল্প করেন, স্যার।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : হাবিব সাহেব, সবচেয়ে বড় কথা কী, আমি বারবার কেন বলতেছি যদি ফাইল নিয়েও যাই, স্যার যদি কিছু চায়, সেটা আপনার বিয়ার করতে হবে। আমি তো পারব না।

হাবিবুর রহমান : আচ্ছা ঠিক আছে, কত টাকা চাইতে পারে?

হারুন নামধারী ব্যক্তি : এটা আমি বলতে পারব না। এখন আপনি থাকলে আমি হয়ত আপনার পক্ষ হয়ে স্যারের সাথে কথা বলতে পারি যে স্যার এই ফাইলটা অনুমোদন করা যায় কিনা বা কি লাগতে পারে।

হাবিবুর রহমান : আমাকে যদি একটু বলেন, তাহলে আমি প্রস্তুতি নিয়ে আসব।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : এ কারণেই বললাম, আপনি যখনই ফাইলটা নিয়ে যাবেন, সই করিয়ে দিলে তখনই ফাইলটা মিটিংয়ে উঠবে। আপনি নেই, আমার পক্ষে তো করা সম্ভব না।

হাবিবুর রহমান : এখনও তো সময় আছে।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : এটা এই মাসের ফাইল না। গত মাসের যেগুলো রিজেক্ট করছে, এনটিআরসিএ-র কাছে যেগুলো অ্যাপ্লাই করছে, সেখান থেকে ফাইলগুলো আসছে। বিশেষ বিবেচনার ৩২টা ফাইলের তালিকা পাঠিয়েছে এনটিআরসিএ।

হাবিবুর রহমান : কী করতে পারি? আপনি আমাকে কী পরামর্শ দিচ্ছেন?

হারুন নামধারী ব্যক্তি : ফাইল এই মাসে আসুক, তারপর দেখা যাক।

হাবিবুর রহমান : আমাকে যদি যোগাযোগ করিয়ে দেন। উনার কী চাহিদা? আনুমানিক কত হতে পারে?

হারুন নামধারী ব্যক্তি : মিনিমাম ২০ থেকে ২৫ পড়ে যাবে।

হাবিবুর রহমান : এত টাকা তো পারব না।

হারুন নামধারী ব্যক্তি : আমি কী বলছি, কথা বুঝেন। আপনি কষ্টের কথাগুলো বলে দেখতে পারেন। তারপরও আমি আপনার পক্ষ হয়ে কথা বলে দেখতে পারি যে, এটা দেওয়া যাবে কিনা। এই মাসে ফাইল আসুক, তারপর দেখি আমি কী করতে পারি।

এএজে/এসকেডি