করোনার কারণে প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে তিন কোটি ৮৬ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। ঝরে পড়া, অসম শিখন সমস্যা, বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনার এ ক্ষতি পোষাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাও এগিয়ে আসছে। এরই অংশ হিসেবে বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে ‘গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন’ (জিপিই) ‘বাংলাদেশ কোভিড- ১৯ স্কুল সেক্টর রেসপন্স (সিএসএসআর)’ প্রকল্পের আওতায় ১৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২০ কোটি টাকা অনুদান দিচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় মোট ২৫ লাখ শিক্ষার্থীকে দূরশিক্ষণের মাধ্যমে প্রথম থেকে দশম শ্রেণির পুরো শিক্ষাবর্ষের জন্য ৩৫টি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করা হবে। এসব কনটেন্ট স্থবির হয়ে পড়া শিক্ষাব্যবস্থাকে বেগবান করবে এবং শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষার মান নিশ্চিত করবে।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হবে— স্কুল বন্ধ থাকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি ও বিতরণ করা; শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্থানীয় জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা; সরকারি নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফের স্কুল চালুর পরিকল্পনা করা এবং নিরাপদ স্কুল চালু করতে তৈরি করা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করা

গত সোমবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বিশ্ব ব্যাংক। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন এবং বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষে কান্ট্রি ডিরেক্টর মের্সি টেম্বন এতে স্বাক্ষর করেন।

করোনায় স্থবির শিক্ষাব্যবস্থা, বাড়ছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও

শিক্ষা ও প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় নতুন শিক্ষাবর্ষে স্কুলে ভর্তি, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে (পরীক্ষা) ও লেখাপড়ার ক্ষতি পূরণে সহায়তা করা; শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সেবা প্রদান; বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলায় বিদ্যালয় ব্যবস্থার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা; ভবিষ্যতে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং মূল বিদ্যালয়ের সঙ্গে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম একীভূত করা; জরুরি পরিস্থিতি তথা দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধের পরিস্থিতিতে কৌশল ও মানসম্মত পরিচালনা কার্যপ্রণালী প্রণয়নে সব ধরনের কারিগরি সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করা হবে।

করোনাপরবর্তী নানা কর্মসূচি আমরা নিয়েছি। এর মধ্যে জিপিই অনুদান হিসাবে ১৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে। চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহ খুশির খবর। এ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে সরকারের কাজে সহায়ক হবে

মো. মাহবুব হোসেন, সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হবে— স্কুল বন্ধ থাকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি ও বিতরণ করা; শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্থানীয় জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা; সরকারি নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফের স্কুল চালুর পরিকল্পনা করা এবং নিরাপদ স্কুল চালু করতে তৈরি করা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করা।

চুক্তিতে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের আওতায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২৫ লাখ শিক্ষার্থীকে (১২ লাখ ৯৫ হাজার ছাত্রী এবং ১২ লাখ ৫ হাজার ছাত্র) একীভূত দূরশিক্ষণ (টিভি, রেডিও ও অনলাইন) সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়া ৩২ লাখ ৪০ হাজার শিক্ষার্থীকে (১৫ লাখ ৯০ হাজার ছাত্র ও ১৬ লাখ ৫০ হাজার ছাত্রী) প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের সরকারি বিদ্যালয়ে পুনঃভর্তি (যারা চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিল) নিশ্চিত করা হবে। মূল বিদ্যালয় ব্যবস্থার সঙ্গে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম পুরোপুরি কার্যকর ও একীভূত করা হবে।

দুর্গম এলাকার দেড় লাখ শিশুর মধ্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা;  স্কুল বন্ধ থাকায় ১৫ লাখ শিশু শিক্ষার্থীকে করোনার নেতিবাচক প্রভাব থেকে উত্তরণে উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রচারণামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং নিরাপদে ফের স্কুল খোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০ হাজার স্কুল খোলা হবে। এছাড়া শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালও তৈরি করা হবে।

স্কুল বন্ধের কারণে শিক্ষার ক্ষতি পরিমাপ করতে তিন লাখ ৫০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা; দুই লাখ শিক্ষককে প্রতিকারমূলক শিক্ষা, দূরশিক্ষণ কৌশল এবং সামগ্রিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন চর্চার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। মূল বিদ্যালয় ব্যবস্থার জন্য মানসম্মত জরুরি পরিচালনা কার্যপ্রণালী তৈরি করা এবং শিখন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সরাসরি ইন্টারভেনশনের (হস্তক্ষেপ) মাধ্যমে তিন কোটি ৫৯ লাখ শিক্ষার্থীকে শিক্ষার আলোয় ফিরিয়ে আনা হবে।

করোনার সংকটে যেসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে তাদের আবারও স্কুলে ভর্তিতে সহায়তা করা; শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে (পরীক্ষা) ও লেখাপড়ার ক্ষতি পূরণে সহায়তা করা; শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সেবা প্রদান; বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলায় বিদ্যালয় ব্যবস্থার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা হবে।

এছাড়া দূরশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং মূল বিদ্যালয়ের সঙ্গে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম একীভূত করা; জরুরি পরিস্থিতি তথা দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধের পরিস্থিতিতে কৌশল ও মানসম্মত পরিচালনা কার্যপ্রণালী প্রণয়ন করা এবং সব কার্যক্রমে কারিগরি সহায়তা সেবা নিশ্চিত করা হবে।

সারাবিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রকল্পটি আনতে হয়েছে। আমদের প্রস্তাব জিপিই’র পছন্দ হওয়ায় ১৫ বিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে। প্রকল্পটি করোনায় শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে সরকারের নানা উদ্যোগকে দারুণভাবে সহায়তা করবে

রতন চন্দ্র পন্ডিত, অতিরিক্ত সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

এছাড়া যখনই স্কুল খোলা হবে তখন প্রায় ২০ হাজার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী হস্তান্তর করা; পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ স্কিমের ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে চুক্তিতে।

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাপরবর্তী নানা কর্মসূচি আমরা নিয়েছি। এর মধ্যে জিপিই অনুদান হিসাবে ১৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে। চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহ খুশির খবর। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে সরকারের কাজে সহায়ক হবে।

জানা গেছে, যখন স্কুল খোলা হবে তখনই এ প্রকল্পের সুবিধা পাবে কয়েক কোটি শিক্ষার্থী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ বাস্তবায়নে প্রকল্প থেকে অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে।

যেভাবে আসল প্রকল্প

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনায় বিশ্বব্যাপী শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে অর্থায়ন করছে গ্লোবাল পার্টনার শিপ ফর এডুকেশন (জিপিই)। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অনুদান পেতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০ মিলিয়ন ডলার চেয়ে আবেদন করে। তবে বাংলাদেশে সংস্থাটির কোনো অফিস না থাকায় বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।

করোনায় বাড়ছে বাল্যবিয়ের সংখ্যাও

প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। জিপিই অনুদান হিসেবে দেবে ১২০ কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও রাজস্ব খচর হিসেবে সরকার অর্থায়ন করবে মাত্র এক কোটি ৮৭ লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হলেও পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। প্রাথমিক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন কমিটিতে থাকবে।

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) রতন চন্দ্র পন্ডিত বলেন, সারাবিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রকল্পটি আনতে হয়েছে। আমদের প্রস্তাব জিপিই’র পছন্দ হওয়ায় ১৫ বিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে। প্রকল্পটি করোনায় শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে সরকারের নানা উদ্যোগকে দারুণভাবে সহায়তা করবে। প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে বলে তিনি জানান।

এনএম/এমএআর/