জন্মনিবন্ধন সনদ না থাকায় উপবৃত্তির অর্থ মিলছে না শিক্ষার্থীদের

এখনও উপবৃত্তির টাকা পায়নি ছয় লাখের বেশি শিক্ষার্থী। ‘নগদ’- এর সঙ্গে প্রাথমিকের উপবৃত্তির অর্থ বিতরণের চুক্তির পর বেশকিছু নতুন শর্ত আরোপ করা হয়। এর মধ্যে শিক্ষার্থীর জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। কিন্তু করোনার মধ্যে জন্মনিবন্ধনের কেন্দ্রীয় সার্ভারে সমস্যা থাকায় অভিভাবকরা সনদ সংগ্রহ করতে পারেননি। ফলে উপবৃত্তির টাকা পাননি তাদের সন্তানরা। এ কারণে মুজিববর্ষ উপলক্ষে জামা-জুতা কেনার এককালীন এক হাজার টাকাও তারা পাচ্ছে না। 

তবে তথ্য সঠিকভাবে আপলোড করতে পারলে পরবর্তীতে উপবৃত্তির টাকা দেওয়া হবে। এজন্য চলতি মাসে আবারও সময় দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির অর্থ বিতরণে রূপালী ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি ছিল। নতুন করে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’র মাধ্যমে অর্থ বিতরণের চুক্তি করে সরকার। এরপর নতুন করে শিক্ষার্থীদের তথ্য নগদ’র সার্ভারের মাধ্যমে সংগ্রহ শুরু হয়। সর্বশেষ এক কোটি ১২ লাখ ৭৪ হাজার ৭৯০ জনের তথ্য সার্ভারে আপলোড হয়েছে।

সার্ভারে আপলোড হওয়া তথ্যের সঙ্গে জন্মনিবন্ধন সনদ না থাকা এবং অন্যান্য ত্রুটি থাকায় ছয় লাখ ২৫৬ শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছে না

এর মধ্যে জন্মনিবন্ধনসহ সঠিক তথ্য রয়েছে এক কোটি আট লাখ ১৪ হাজার ৫৩৪ জনের। সঠিক তথ্য থাকা শিক্ষার্থীদের গত বছরের এপ্রিল থেকে জুনের বকেয়া উপবৃত্তির টাকা গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিতরণ শেষ হয়েছে। কিন্তু সার্ভারে আপলোড হওয়া তথ্যের সঙ্গে জন্মনিবন্ধন সনদ না থাকা এবং অন্যান্য ত্রুটি থাকায় ছয় লাখ ২৫৬ শিক্ষার্থী এ কিস্তির উপবৃত্তির টাকা পায়নি।

হাত ধুয়ে স্কুলে আসার প্রস্তুতি, সঙ্গে পানি নিয়ে খেলার মজাও আছে 

জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রদান প্রকল্পের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. ইউসুফ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত বছরের দ্বিতীয় কিস্তির বকেয়া টাকা গত ফেব্রুয়ারিতে বিতরণ শেষ হয়েছে। যাদের তথ্যে ত্রুটি আছে তাদের এ কিস্তির টাকা দেওয়া হয়নি। তবে তথ্য আপডেট করলে পরবর্তীতে কিস্তির টাকা পাবে।’

গত বছরের দ্বিতীয় কিস্তির বকেয়া টাকা গত ফেব্রুয়ারিতে বিতরণ শেষ হয়েছে। যাদের তথ্যে ত্রুটি আছে তাদের এ কিস্তির টাকা দেওয়া হয়নি। তবে তথ্য আপডেট করলে পরবর্তীতে কিস্তির টাকা পাবে

মো. ইউসুফ আলী, প্রকল্প পরিচালক

তিনি আরও বলেন, সার্ভারে শতভাগ তথ্য আপলোড করা না হলে কাউকে উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার সুযোগ নেই।

নতুন করে তথ্য আপডেটের সুযোগ দেওয়া হবে কিনা— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চলতি মাসের ১৫ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত নতুন করে তথ্য আপলোডের সুযোগ দেওয়া হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য আপলোড করলে শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে উপবৃত্তির টাকা পাবে।’

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উপবৃত্তি ও কিডস অ্যালাউন্স দিতে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাড় করেছে। নিয়মিত এক কোটি ১০ লাখ শিক্ষার্থীর কিডস অ্যালাউন্স বাবদ প্রায় ১১০০ কোটি টাকা এবং গত বছরের তিন কিস্তির বকেয়া উপবৃত্তির টাকা বিতরণ করা হবে। প্রতি কিস্তির উপবৃত্তি বিতরণে খরচ হবে ৪৫০ কোটি টাকা।

চলতি মাসের ১৫ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত নতুন করে তথ্য আপলোডের সুযোগ দেওয়া হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য আপলোড করলে শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে উপবৃত্তির টাকা পাবে

মো. ইউসুফ আলী, প্রকল্প পরিচালক

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, উপবৃত্তি প্রকল্পের (তৃতীয় পর্যায়) মেয়াদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়। করোনার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে বিলম্ব হয়। উপবৃত্তির টাকাও বকেয়া পড়ে যায়। পরবর্তীতে উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে আগামী জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। আগে রূপালী ব্যাংকের শিওর ক্যাশ’র মাধ্যমে অভিভাবকদের মোবাইল ফোনে সরাসরি টাকা বিতরণ করা হতো। কিন্তু এ পদ্ধতিতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।

টাকা বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় গত ১৩ ডিসেম্বর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও শিক্ষার উপকরণ ভাতা ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিতরণের জন্য বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’-এর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নগদ’র মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা বিতরণে সরকারের খরচ এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। আগে শিওর ক্যাশ ১০০ টাকায় সার্ভিস চার্জ নিত আড়াই টাকা, সেখানে নগদ-কে দিতে হচ্ছে মাত্র ৭০ পয়সা। তবে শিওর ক্যাশ রূপালী ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের বিতরণ না করা টাকা ফেরতের সুযোগ ছিল। কিন্তু নগদ’র মাধ্যমে এ সুযোগ নেই।

শিক্ষকরা বলেন, তথ্য আপলোডে যে এনআইডি নম্বর দেওয়া হবে তা নিবন্ধিত মোবাইল সিমে ব্যবহার করতে হবে। গ্রামের অনেক অভিভাবকের মোবাইলে সিম কার্ড অ্যানালগ এনআইডি দিয়ে নিবন্ধিত। অ্যানালগ এনআইডি কার্ডগুলো স্মার্ট কার্ড হওয়ায় পোর্টালের সঙ্গে মিলছে না। আবার অনেকের সিম নিবন্ধিত নয়। কারও মোবাইল নিবন্ধিত আইডি কার্ডের নামের সঙ্গে মিল নেই

প্রকল্প সূত্র জানায়, নতুন চুক্তি অনুযায়ী নগদ’র সার্ভারে নিবন্ধন করতে শিক্ষার্থীর জন্মসনদ, অভিভাবকের মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর বাধ্যতামূলক করা হয়। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শতভাগ শিক্ষার্থীর তথ্য সার্ভারে আপলোড করতে পারেননি শিক্ষকরা। গত জানুয়ারি মাসে কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও শতভাগ শিক্ষার্থীর তথ্য নগদ’র সার্ভারে আপলোড করা সম্ভব হয়নি।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষকরা বলেন, তথ্য আপলোডে যে এনআইডি নম্বর দেওয়া হবে তা নিবন্ধিত মোবাইল সিমে ব্যবহার করতে হবে। গ্রামের অনেক অভিভাবকের মোবাইলে সিম কার্ড অ্যানালগ এনআইডি দিয়ে নিবন্ধিত। অ্যানালগ এনআইডি কার্ডগুলো স্মার্ট কার্ড হওয়ায় পোর্টালের সঙ্গে মিলছে না। আবার অনেকের সিম নিবন্ধিত নয়। কারও মোবাইল নিবন্ধিত আইডি কার্ডের নামের সঙ্গে মিল নেই।

এছাড়া করোনার কারণে অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের মোবাইলও বন্ধ। অনেক অভিভাবকের এনআইডি কার্ড আপডেট নেই। কেউ কেউ আইডি কার্ড তুলতে পারেননি। এসব কারণে কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর তথ্য সঠিকভাবে সার্ভারে আপলোড করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রাক-প্রাথমিকের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ৫০ টাকা হারে উপবৃত্তি দেওয়া হতো। এখন তা বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক স্তরের এক সন্তান বিশিষ্ট পরিবারের মাসিক উপবৃত্তি ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করা হয়েছে। দুই সন্তান বিশিষ্ট পরিবারের উপবৃত্তি ৩০০ টাকা, তিন সন্তান বিশিষ্ট পরিবারের উপবৃত্তি ৪০০ টাকা এবং চার সন্তান বিশিষ্ট পরিবারের উপবৃত্তি ৫০০ টাকা করা হয়েছে।

ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু আছে এমন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এক সন্তান বিশিষ্ট পরিবারের শিক্ষার্থীর মাসিক উপবৃত্তি ১২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা, দুই সন্তান বিশিষ্ট পরিবারের ৪০০ টাকা, তিন সন্তান বিশিষ্ট পরিবারের ৫০০ টাকা এবং চার সন্তান বিশিষ্ট পরিবারের শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি ৬০০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া মুজিববর্ষ উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের জামা-জুতা কেনার জন্য কিডস অ্যালাউন্স বাবদ এক হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে।

এনএম/এইচকে/এমএআর/