ছবি- সংগৃহীত

# পদ্ধতির নাম পাঠদান মূল্যায়ন
# শিক্ষকদের কাজের ওপর মত দেবেন শিক্ষার্থীরা
# ২১টি বিষয়ে মতামত দেওয়া যাবে
# সর্বোচ্চ পয়েন্ট ৫, সর্বনিম্ন ২.৫

শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে শিক্ষকদের ‘দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা’ বাড়াতে টিচিং ইভ্যালুয়েশন বা শিক্ষকদের পাঠদান মূল্যায়ন পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। পাঁচটি সূচকে মোট ২১টি প্রশ্নের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের মূল্যায়ন করবেন। আগামী বছরের প্রথম থেকে এটি চালু হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এই পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কেমন পাঠদান করেন, ক্লাসের রুটিন অনুযায়ী সময়মতো ক্লাস শুরু করেন কি না, নির্দিষ্ট সময়ে কোর্স শেষ করেন কি না, জ্ঞানভিত্তিক লেকচার দেন কি না, কোর্সের বিষয়বস্তু কেমন, ক্লাসগুলো আকর্ষণীয় এবং প্রাণবন্ত করতে পারছেন কি না, শ্রেণিকক্ষে আরামদায়ক একাডেমিক পরিবেশ তৈরি করতে পারছেন কি না, কোর্স ম্যাটারিয়ালস সরবরাহ করছেন কি না, পরীক্ষা-অ্যাসাইনমেন্ট ঠিকমতো নিচ্ছেন কি না এবং সেগুলোর ঠিকমতো মূল্যায়ন হচ্ছে কি না, সামগ্রিকভাবে শিখন প্রক্রিয়া কার্যকর ছিল কি না- এমন মোট ২১টি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

জানা গেছে, কোনো একটি কোর্স অধ্যয়ন শেষে কিংবা বছর শেষে শিক্ষার্থীদের গুগল ফরম দেওয়া হবে। সেখানে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত জানতে চাওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে নম্বর দেওয়ার সুযোগ পাবেন। সেগুলোর গড় করে শিক্ষকের সামগ্রিক স্কোর নির্ধারণ করা হবে। ৫ পয়েন্টকে সর্বোচ্চ সীমা ধরে ২.৫ পয়েন্টকে সর্বনিম্ন এবং ৪.৫-৫ পয়েন্টকে ‘সবচেয়ে ভালো’ শিক্ষক হিসেবে ধরা হবে। শিক্ষার্থীদের এসব মতামতের বিষয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষক জানতে পারবেন না। শুধু বিভাগীয় প্রধান এবং অনুষদ ও ইনস্টিটিউটের প্রধানরা এটি জানতে পারবেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী খালেদ মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল ধারণা হলো, শিক্ষকরা সিনিয়র স্কলার, আর শিক্ষার্থীরা জুনিয়র স্কলার। তাই শিক্ষকদের সবসময় পঠন-পাঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক বিষয়েও আপডেট থাকতে হয়। সেজন্য তাদেরও প্রচুর লেখাপড়া করতে হয়। কিন্তু আমাদের অনেক শিক্ষক এসব থেকে যোজন যোজন দূরে থাকেন। যার ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে প্রকৃত শিখন থেকে বঞ্চিত হন। শিক্ষক মূল্যায়নের এ প্রক্রিয়া সার্বিক বিষয়গুলোতে একটা স্বচ্ছতা নিয়ে আসবে।’

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মাজহারুল ইসলাম রবিন বলেন, ‘একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কেমন পাঠদান করছেন তার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। শিক্ষার্থী কোনো শিক্ষকের কাছে ভালোভাবে শিখতে পারলে তিনি ভবিষ্যতে ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে পারবেন। তাই আমার মনে হয়, এই পদ্ধতি চালু হওয়া সময়ের দাবি ছিল।’

ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার বলেন, ‘আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এই পদ্ধতি চালু করা সময়ের দাবি ছিল। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাধুবাদ জানাই। মানসম্মত শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে এই শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছি।’

উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা বলেন, আমাদেরকে শিক্ষার্থীরা মূল্যায়ন করবে এটা অবশ্যই ভালো দিক। আমাদের জন্য শিক্ষার্থীরা নয়, আমরাই শিক্ষার্থীদের জন্য। শিক্ষক হিসেবে আমাদের কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা। সে বিতরণের কাজটা আমরা ঠিকঠাক করছি কিনা, আমাদেরকে আপডেট রেখেছি কিনা, শিক্ষাদানের সঙ্গে যথাযথভাবে যুক্ত আছি কিনা। সেটা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সবচেয়ে ভালো মূল্যায়ন হবে। আমরা তো সবকিছুর ঊর্ধ্বে না, আমরা তো মানুষ আমাদের তো ভুল ত্রুটি হতে পারে। এই মূল্যায়নের মাধ্যমে যেখানে ত্রুটি বিচ্যুতি আছে সেগুলো আমরা সংশোধন করতে পারব। তাই শিক্ষার্থীদের ইভ্যালুয়েশন অবশ্যই ভালো দিক। তবে প্রথম তো অনেক ধরনের সমস্যা হয়ত থাকবে তবে এটা আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখছি।

এ বিষয়ে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি এটাকে খুব ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। এতে শিক্ষার মান বাড়বে বলে বিশ্বাস করি। শিক্ষকরা তাদের নিজেদের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা জানতে পারবেন। সেই অনুযায়ী তারা তাদের শিখন পদ্ধতি সম্পর্কে উন্নতি করতে পারবেন। আমি এটাও বিশ্বাস করি আমাদের মধ্যে গবেষণা, লেখাপড়া, ক্লাস নেওয়া এবং চিন্তা-চেতনার প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এই মৌলিক দায়িত্বের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। এই প্রতিযোগিতার অর্থ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা। তাই আমি একজন শিক্ষক হিসেবে এই কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই।’

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘টিচিং ইভ্যালুয়েশনকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। এই কার্যক্রম শিক্ষার মানকে আরো সমৃদ্ধ করবে। এর মাধ্যমে শিক্ষকরা আরো দায়িত্বশীল হবেন। যারা ক্লাসের ব্যাপারে আন্তরিক নন, ক্লাস কম নেন তারা সচেতন হবেন এবং আরো বেশি প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে যাবেন। আশা করি আমাদের প্রত্যেক শিক্ষক এটিকে ইতিবাচক হিসেবে নেবেন এবং এর মাধ্যমে ভালো ফল আসবে। আমি মনে করি, শিক্ষার উন্নয়নের জন্য শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি চালু করা উচিত।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা, কোয়ালিটি বাড়ানো এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইন্টারঅ্যাকশন বাড়ানো, শিক্ষকের রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি বাড়ানো। সর্বোপরি শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করে, শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা এবং গবেষণা নিশ্চিত করার জন্য এই কার্যক্রমটা আমরা শুরু করেছি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী খালেদ মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল ধারণা হলো, শিক্ষকরা সিনিয়র স্কলার, আর শিক্ষার্থীরা জুনিয়র স্কলার। তাই শিক্ষকদের সবসময় পঠন-পাঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক বিষয়েও আপডেট থাকতে হয়। সেজন্য তাদেরও প্রচুর লেখাপড়া করতে হয়। কিন্তু আমাদের অনেক শিক্ষক এসব থেকে যোজন যোজন দূরে থাকেন। যার ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে প্রকৃত শিখন থেকে বঞ্চিত হন। শিক্ষক মূল্যায়নের এ প্রক্রিয়া সার্বিক বিষয়গুলোতে একটা স্বচ্ছতা নিয়ে আসবে। 

তিনি বলেন, ‘এই কার্যক্রমের মাধ্যমে আমাদের কোনো শিক্ষকের যদি কোনো ঘাটতি দেখা যায়, তখন সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে মূল্যায়নের ফরমটি শিক্ষকের কাছে হস্তান্তর করবেন এবং সেখান থেকে নিজেকে আরো ইমপ্রুভ করার ক্ষেত্র খুঁজে পাবেন। এই কার্যক্রমে সম্পূর্ণ গোপনীয়তার বিধান উল্লেখ রয়েছে। এটি চালু করার আগে ধারণা দেওয়ার জন্য বিশেষ সেমিনার ও ওয়ার্কশপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি, আগামী বছরের প্রথম থেকে মূল্যায়নের এই কার্যক্রম শুরু করতে পারব।’ 

এইচআর/জেডএস