১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সনমান্দী উচ্চ বিদ্যালয় ৫০ বছরে পদার্পণ করল ২০২৩ সালে। ২০২৩ সন স্কুলটিরে সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর। সনমান্দী একটি ছোট্ট গ্রামের নাম। যার অবস্থান মাদারীপুর জেলার বর্তমান ডাসার উপজিলার বালিগ্রাম ইউনিয়নে। অবস্থানের দিক থেকে মাদারীপুরের ইটের পুল বা মিলগেট থেকে পাথুরিয়ারপারগামী সোজা রাস্তার পূর্ব পাশে। স্কুলটির সুবর্ণ জয়ন্তী স্মরণ করার জন্য নিজের ঢোল খানিকটা পিটাতে হচ্ছে নিজেকেই।  

আমার নাম গোবিন্দ চন্দ্র বাড়ৈ। আমি এই সনমান্দী গ্রামেরই সন্তান। ঠিকানা : গ্রাম সনমান্দী যা বালিগ্রাম ইউনিয়ন, ডাসার উপজেলা এবং মাদারীপুর জেলার অন্তর্গত। আমি পিতা বাঞ্চারাম বাড়ৈ এবং মাতা প্রিয়বালা বাড়ৈর বড় সন্তান। আমি বিবাহিত এবং ৩ কন্যার জনক, যারা সকলেই প্রকৌশলী।

কর্মজীবনের প্রথম ৬ বছর আমি ইউনিভার্সিটি উইমেন্স ফেডারেশন কলেজের গণিতের শিক্ষক ছিলাম। পরে বিমান বাংলাদেশ এয়ালাইন্সে কাজ করি। বিমান থেকে অবসরের পর অন্যান্য প্রাইভেট এয়ারলাইন্সে উচ্চ পদে কাজ করি। বর্তমানে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের বিশেষ পরিদর্শক পদে কর্মরত। পাশাপাশি আমি এভিয়েশন সম্পর্কিত বিষয়ের প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করছি। সুযোগ পেলেই লেখালেখি করা আমার অন্যতম শখ। আমার লেখার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- মহাজগৎ ও পৃথিবী, কেমন করে উড়ছে মানুষ, পাঁচমিশালী পদ্যাবলী, ছোটদের মজার ছড়া ইত্যাদি। আরো কিছু বই প্রকাশের অপেক্ষায়। 

আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তারপরেও ছোট সময় থেকেই মনে হতো নিজের পাশাপাশি পরিবারের প্রতি যেমন কর্তব্য আমাকে পালন করত হয়, পালনীয় এমন কর্তব্য রয়েছে গ্রামের তথা এলাকার মানুষের প্রতিও। তাই স্কুল ছুটির দিন গ্রামের পথঘাট ঘুরে দেখতাম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতাম, প্রয়োজনে শাসন এড়িয়ে গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের খোঁজ-খবর নিতাম- তারা নিয়মিত স্কুলে গিয়েছিল কিনা, দুষ্টুমী করেছে কিনা এসব। আর এদের অভিভাবকরাও আপন করে নিত আমাকে, বলে দিত সব গোপন সত্য কথা। অনেক অভিযোগ- অনুযোগ ও থাকতো। এসব নিয়ে ছোটদের উপদেশও দিতে হতো। 

আমার জম্ম ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে। পরে অবশ্য মায়ের হিসাব থেকে মনে হয়েছে ডিসেম্বর নয়- আমার জন্ম হয়েছিল ফাল্গুন মাসে। যাই হোক ১৯৬৬ সনের দিকে যখন আমি ৯ম- ১০ম শ্রেণির ছাত্র, স্বতঃস্ফুর্তভাবে অনেকে এগিয়ে এসেছিল আমার সঙ্গে সমাজের বা গ্রামের কাজ করার জন্য। ফলে একটা টিম বা দল গঠন হয়ে যায়। ওই সময়ে বাগান পরিষ্কার করে মাঠ তৈরি করে, চাঁদা তুলে তহবিল সংগ্রহ করে ব্যবস্থা করে করা হয়েছিল ভলিবল ও ব্যাডমিন্টন খেলার, গড়ে তুলেছিলাম ক্লাব। 
 
আমাদের গ্রামের পাশ দিয়া প্রবাহমান ছিল একটি বড় খরস্রোতা খাল। বরিশালের বালাম চাল, কুড়িয়ানার পেয়ারা, আর পাট ব্যবসায়ীদের গোপালপুর হাটে কেনা পাট এসব নিয়ে বড় বড় নৌকা যেত এ খাল দিয়ে পালতুলে, গুণটেনে, বৈঠা বেয়ে। খালের পাড়ের বড় রাস্তা থেকে আমাদের গ্রামে আসার জন্য ছিল কাঠের একটা বড় পুল। পুলের শুরুটা ছিল রাস্তার পূর্ব পাড় থেকে, আর পশ্চিম পাড়ে ছিল একটা বড় বটগাছ। এইজন্য এ পুলের পরিচয় ছিল বটগাছের গোড়ার পুল। পুলের কাঠে খোদাই করা 1961 (দুই দিক থেকে একই সংখ্যা) থেকে আজও মনে পড়ে সংখ্যাটি ৷ পুলটি নতুন করে করা হয়েছিল ১৯৬১ সনে। আর ১৯৬৯ সনে পুলটি ভেঙে চুড়ে এমন হয়েছিল যে, স্বাভাবিক অবস্থায় দিনের আলোতেও খুব সাবধানে চলাচল করতে হতো । রাতের বেলা বা কাদা মাখা পায়ে এ পুল পার হওয়াটা ছিল রীতিমতো সাধনা বা কষ্টকর। আমার সেই শিশু-কিশোর দল নিয়ে বাঁশের মাচার মতো তৈরি করে তা দিয়ে মেরামত করেছিলাম এ পুল। এ কাজের জন্য অনেক প্রশংসা পেয়েছিলাম এলাকার মানুষের কাছ থেকে। এ পুলের পরবর্তী মেরামত হয়েছিল স্বাধীনতার পরবর্তী কালে। 

আমি যখন নাজিম উদ্দীন কলেজের বিএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র তখনই সংঘটিত হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আমাদের গ্রামের ডাক্তার (হোমিও) বাবু নিত্যানন্দ ঘরামীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ইউনিয়ন পরিষদের আমাদের ওয়ার্ডের সদস্য হিসাবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসাবে অনেক কাজ। কিন্ত আমাকে ছাড়া সদস্য মহোদয় এক পা বাড়াতেও নারাজ। তাই তার সাথে কাজ করতে হলো আমাকেও। ভূমিকাতে আমি নিজের কথা বললাম এতক্ষণ।

আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া যে রাস্তার কথা বলা হলো তা ছিল কাঁচা । বর্ষায় কীদা, শুকনায় ধুলা- এ ছিল সর্ব সময়ের সাথী। উত্তরে মাদারীপুর, দক্ষিণে গোপালপুর, বীরমোহন, ভূরঘাটা, যাই বলি, রাস্তা বলতে ছিল একটাই । মাঝে মাঝে গরু পালন করা হতো এই রাস্তায়। ফলে বর্ষার দিনে কাদা আরো বেশি হতো। তবে মাঠঘাট শুকিয়ে গেলে মাঠের মধ্য দিয়ে পথ পড়ত হাঁটার জন্য। মাঠের মধ্য দিয়ে চলতে অনেক সময় জমির আইল ধরে হাঁটতে হতো।  

জমির আইল ধরে পথ হবার কারণে দূরত্ব এমন একটা কম হতো না । রৌদ্র, বৃষ্টি, কাদা ভেঙে চলা এখন অস্বাভাবিক মনে হলেও আজ পিছনের দিকে ফিরে তাকালে মনে হয় - অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলাম আমরা। আমাদের গ্রাম থেকে উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর দূরত্ব চার থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মতো হলেও ডনোভান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের দূরত্ব আরও অনেক বেশি। নাজিমউদ্দীন কলেজের দূরত্বও চার থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মতো। ফলে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় অতিক্রমের পর পড়াশুনার গভীর আগ্রহ বা অভিভাবকদের চাপ না থাকলে উচ্চ বিদ্যালয়ে যাওয়া আর হতো না। সঙ্গে তখনকার দিনে অর্থনৈতিক সাম্যের একটা প্রশ্ন ছিল। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে কোনোটাই ভাববার অবস্থা ছিল না। ফলে হেসেলে ঢুকে উনানে হাড়ি চড়ানো অথবা স্বামীর ঘরে গমন ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় পার হবার পর তাদের ভাগ্য। তারপরও দুই-একটা মেয়ে যে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতো না তা কিন্তু নয়।

১৯৭২ সনের শেষার্ধ। কলেজে আমার বিএসসি ক্লাসের পড়াশোনা আবার শুরু হয়েছে। আমাদের গ্রামের একটি মেয়ে পড়তো ডনোভান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। অন্যান্য অনেক দিনের মতোই অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। বিকেলে বৃষ্টিটা খানিকটা কমে আসায় বেরুলাম বাড়ি থেকে। গন্তব্য ধোপার ভিটা নামক একটা ভিটায়। আসলো আরো ২ -৪ জন। একজন বলল ডনোভান বালিকা বিদ্যালয়ে পড়া মেয়েটি সম্পর্কে । বলল- আজ সারাপথ ভিজে ভিজে স্কুল থেকে ঘরে ফিরেছে সে। স্কুল থেকে মানে ডানোভান গার্লস স্কুল থেকে । মেয়ে বলে ভিজা কাপড়ে কোথায়ও দাঁড়ায়নি রাস্তায় । ছাতাও ছিল না সঙ্গে। ঘটনাটা আমার মাথায় আঘাত করল ।

কাছে স্কুল না থাকায় মেয়েরা সাহস করে উচ্চ শিক্ষার দিকে এগুতে পারে না। তারপর এমন অবস্থায় পরলে এরাও হয়তো পড়াশুনা বন্ধ করে দেবে। আর এমনটি তো এক দুই দিনের নয়। এর একমাত্র সমাধান হলো কাছাকাছি একটি হাই স্কুল বা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা । আমি ভাবতে থাকলাম- সিদ্ধান্ত নিলাম একটা দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে হবে । আমার ভরসা হলো এলাকার মানুষের বিশ্বাস।

পরের দিন সন্ধ্যার ঘটনা । বিকালের দিকে আবহাওযা ভালো থাকলে আমরা মাঝে মাঝে জড়ো হতাম আবদুল মতিন হাওলাদার বা মতি ভাইদের বাড়িতে । মতি ভাই আমার চেয়ে ৩ বছরের বড় । তারপরও ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক ।

সেখানে আসতো সমবয়সী আবদুল হাই হাওলাদার, আতাউর রহমান খান, ছোট ভাই প্রতীম মাসুদুর রহমান খান বাবলু, মজিবর রহমান খানসহ আরো অনেকে। মাঝে মাঝে আসত সুবোধ চন্দ্র মজুমদারও। মতি ভাইদের বাড়িতে ছিল কেরম বোর্ড । বিল্ডিং এর সামনে অর্থাৎ পশ্চিম পাশে ছিল খোলা ঘাসে ঢাকা মাঠ । ঘাস ভিজা থাকলে আড্ডা হতো বারান্দায় । সময়টা সম্ভবত আএস্টর শেষ কিংবা সেপ্টেম্বরের প্রথম । আমি সকলকে উদ্দেশ্য করে বললাম - গ্রামে আমি একটা হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চাই । না হলে মেয়েদের পক্ষে পড়াশোনা সম্ভব নয়। সকলের সহযোগীতা চাই। সকলে সমস্বরে বলল- আমাদেরকে কী করতে হবে বলে দাও বা বলে দেন, আমরা আছি। সিদ্ধান্ত নিলাম সব ব্যবস্থা এ বছরই করে রাখব, ক্লাশ শুরু করব ১৯৭৩ এর জানুয়ারি মাস থেকে। শুরু করব ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির ক্লাশ। ক্লাশ হবে প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে, মর্নিং শিফটে । প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও ভালো মানুষ । তার কাছে প্রস্তাব রাখায় খুব খুশী হয়ে তা গ্রহণ করলেন এবং তিনি সাহসও যোগালেন এগিয়ে যাবার ।

নেমে গেলাম নিজ গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামে ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহের জন্য। বুঝতে পারলাম শুধু নিজ গ্রামেই নয়, পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষেরও ভরসা আছে আমার উপর । বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীও পেয়ে গেলাম । এর মধ্যে প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্র-ছাত্রীও ছিল কয়েকজন । সবার নাম আজ স্মরণ করতে পারছি না। একাজে যারা আমার সহযোগী ছিলেন তাদের মধ্যে মতিভাই, আবদুল হাই হাওলাদার, আবদল মতিন খান, শ্রদ্ধেয় মাওলানা মনির উদ্দিন খান সাহেব তার কাছারি ঘর ছেড়ে দিয়েছিলাম অফিসিয়াল কাজকর্ম করার জন্য । পরবর্তীতে তিনি দূর থেকে আসা শিক্ষকদের থাকার ব্যবস্থাও করেছিলেন এ ঘরে । শ্রী সুবোধ চন্দ্র মজুমদারের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল প্রধান শিক্ষক হিসাবে । শিক্ষকতা শুরু করেছিল আবদুল মতিন হাওলাদার, আবদুল হাই হাওলাদার, আবদুল মতিন খান,আতাউর রহমান খান । আমি ও পড়াতাম ।

এক যুবক বিনা বেতনে শিক্ষকতা করার আগ্রহ প্রকাশ করল । তার থাকার ব্যবস্থা করা হলো মাওলানা মনির উদ্দিন খান (মাসুদুর রহমান ও ওয়াহিদ্বুর রহমানের পিতা) সাহেবের কাছারি ঘরে । মাওলানা মনির উদ্দিন খান সাহেবের বড় অবদান হলো ওয়াহিদুর রহমান খান এর মত প্রতিশ্রুতিশীল সন্তানকে অনিশ্চিত এ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা একমাত্র আমার ওপর ভরসা করে । বলে রাখা ভালো এই উচ্চ বিদ্যালয়ের অবদান সনমান্দী গ্রামসহ ছোট বনগ্ৰাম, কুন্তিপাড়া, করদি, ধুলগ্রাম, খাতিয়ালসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগ্তলোর অনেক মানুষেরই। তাদের সবার কথা বলা সম্ভব নয়। তবে আবুল বাশার ফরাজি, জয়কৃষ্ণ বাড়ৈ, নির্মল ঘরামী, যারা শুরু থেকেই স্কুলে কাজ করেছে তাদের কথা অবশ্যই স্মরণ করতে হবে । 

প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে ক্লাশ শুরু করে একটা অসুবিধার সম্মুখীন হলাম । তা হলো- ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে যারা বই-খাতা ক্লাশ রুমে রেখে খেলা-ধুলার উদ্দেশ্যে সকাল সকাল স্কুলে আসত তারা দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত। এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য ভিন্ন চিন্তা করলাম । ঠিক করলাম স্কুল মাঠের পূর্বদিকে একটা ঘর করব । যে ভাবনা সে কাজ। প্রধান শিক্ষক মহোদয়ের অনুমতি নিলাম বসন্তকালের এক পূর্ণিমা রাতে আমার দলবলকে বললাম কোদাল নিয়ে আসতে । রাতে মাটি কেটে ভিটি তৈরী করলাম । এবাড়ি ও বাড়ি থেকে বাশ, খড়, পাটখড়ি এনে তৈরী করলাম একচালা ঘর । পার্শ্ববর্তী বাড়ি-ঘর থেকে আনা হলো চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ ইত্যাদি যাদের যাকিছু ছিল । ক্লাশ শুরু হলো সেখানে । এসব কাজের ফাঁকে পড়াশুনা করে আমার বিএসসি পরীক্ষা শেষ করলাম । এসময় কালকিনি কলেজে কলেজে ক্লাশ শুরু করা হয়েছে কালকিনি উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন মাঠে ঘর করে । তখন কালকিনি কলেজের অধ্যক্ষ বাবু লক্ষণ চন্দ্র সিকদার ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তার অনুরোধ - সেখানে যেন আমি শিক্ষকতা করি। নতুন কলেজ, এক এক দিন এক এক বিষয়ের শিক্ষক থাকে না। এসব বিষয় আমাকে পড়াতে হতো । খানিকটা কষ্ট হলেও দুই দিকই সামাল দিতে হচ্ছিল সমান তালে । কালকিনি আবুল হোসেন কলেজের ভিত্তি তৈরীর মাটি কাটার কাজে অংশ গ্রহন করি এ সময়েই ।

এবার আসা যাক আমাদের স্কুলের কথায় । তখন দরকার জায়গার, দরকার ঘরের । গেলাম ইউনিয়ন পরিষদের আমাদের এলাকার প্রাক্তন সদস্য শ্রদ্ধেয় মোত্তাজদ্দীন হাওলাদার সাহেবের কাছে । এখানে উল্লেখ্য, যে গ্রামের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজের জন্য আমার যা কিছুর দরকার হতো, এ মোন্তাজদ্দীন হাওলাদার সাহেবই আমাকে ব্যবস্থা করে দিতেন। তাকে সব বুঝিয়ে বললাম, খুশী হলেন তিনি । বললেন, রাস্তার পাশে একটা জায়গা আছে, স্কুলের জন্য খুবই উপযোগী । তবে কাগজ পত্রে বেশ ঝামেলা আছে । জমিটি শেষ পর্যন্ত কে পাবে
জানি না। স্কুলের নামে জমিটি দিলে স্কুলের জন্য খুব ভাল একটা অবস্থান হবে, কারোর পক্ষে ঝামেলা করার তেমন কোন সুযোগ থাকবে না। মৌখিকভাবে তিনি এ জায়গাটি স্কুলের জন্য দান করলেন । আমিতো ভীষণ খুশী । সাদা কালো রং কিনে কুড়িয়ে পাওয়া একটা টিনে লিখলাম- “সাইট ফর সনমান্দী জুনিয়র হাই স্কুল' । আর শক্ত একটা কাঠির মাথায় লাগিয়ে পুতে দিলাম এ জায়গায় । সবাই যেন আকাশথেকে পড়ল । সবার সে কী প্রশংসা ! মনে হলো স্কুলটি দৃশ্যমান হলো এ জায়গায় । আমার সাহস বেড়ে গেল। চাঁদা তুলে হলেও ঘর করা যাবে । এবার এগুলাম ভিন্ন পথে । ততদিনে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়ে গেল। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলো আমার এক ছাত্র ও ছোট ভাই, নাম মজিবর রহমান খান । আমি ওকে সব বললাম এবং দাবী করলাম একটি ঘর ও আসবাবপত্র দেওয়ার জন্য । আমি গর্বিত যে আমার এ ছাত্র এসব দিবে বলে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিল। ইতোমধ্যে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে মাস্টার্স-এ ভর্তি হয়েছি। আমার অনুপস্থিতিতে সব কাজ করে দিল চেয়ারম্যান মজিবর। এবার আমার ছুটাছুটি শুরু হলো ঢাকা আর সনমান্দী গ্রামে । ইতোমধ্যে আমরা দূর থেকে আসা আরও একজন শিক্ষককে পেয়ে গেলাম, যার নাম ছিল মোহাম্মদ মোতালেব। তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমি ।

সনমান্দী জনিয়র হাইস্কুল নামটি বেশীদিন রাখতে হয়নি। নতুন নামকরন হলো সনমান্দী উচ্চ বিদ্যালয় । ৮ম শ্রেণী থেকে পাশকরা ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া ভর্তী হলো আরও কিছু ছাত্র-ছাত্রী । কেউ কেউ কিছু কিছু বেতন দিতেও শুরু করেছিল।

এমপিওভুক্তির ব্যাপারে স্কুলথেকে যেমন চেষ্টা করাহচ্ছিল চেষ্টা করছিলাম আমিও। ঠিক সময়ে এমপিও ভুক্তও হয়েছিল স্কুলটি ।

আমাদের সে স্কুলে এখন টিনের ঘরের পাশে আছে বিল্ডিং, বড় লাইব্রেরীও । উপযুক্ত শিক্ষকগণ শিক্ষা দান করেন। স্কুলটি আজ সুনাম অর্জন করতে পেরেছে। বাহির থেকে দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছে স্কুলটি । আমি তৃপ্ত একটা কারণে যে, মেয়েরা লেখাপড়া শিখেতে পারছে কম কষ্টে । এখানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও অনেক । পরীক্ষার ফলাফল ও মন্দ নয়। তবে একটা অতৃপ্তি রয়েই গেছে। তা হলো - স্কুল থেকে আমার কাছে একসময় বিজ্ঞানের হাতে কলমে শিক্ষার জন্য কিছু সরঞ্জাম দাবী করা হয়েছিল- তা আমি দিতে পারিনি। পাশাপাশি খেলাধুলার কিছু সরঞ্জামের দাবী ছিল। আমার সার্মথের মধ্যে থাকায় তার কিয়দংশ মাত্র আমি পূরণ করতে পেরেছিলাম। তারও বোধ হয় কিছুই আর
অবশিষ্ট নাই ।

আমি খেলাঘরের একটি শাখা যেমন স্থাপন করেছি, সনাতন সমাজ কল্যাণ সংঘ নামের একটি সামাজিক সংগঠনও গড়েছি, যা এখনো কাজ করছে । গ্রামে খেলাধুলার প্রসারের জন্য গড়েছিলাম একটি ক্লাব ও যা আমি গ্রাম থেকে আসার পর বন্ধ হয়ে যায়। সততা ও সৎ প্রচেষ্টার জন্য পেশাগত দিক থেকেও আমার একটা সুনাম আছে বলে মনে হয়। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখির প্রচেষ্টাও ছিল সেই ছাত্র জীবন
থেকেই। দৈনিক সংবাদের খেলাঘরের পাতাসহ বিভিন্ন সময় ছড়া, কবিতা, বিভিন্ন নামে আর্টিক্যালও লিখতাম। এসবের পরও আমি পরিচিত হতে চাই সনমান্দী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে । কারণ এটি যে শিক্ষা প্রসার, তথা নারী শিক্ষা আন্দোলনের অঙ্গ । পরিচিত হতে চাই সমাজ কর্মী হিসাবে। 

এ বিদ্যালয়টির উত্তরোত্তর উন্নয়নের জন্য সবার সহযোগীতা কামনা করছি। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি- এখানে উচ্চ মাধ্যমিক খুলে দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে । তা হলে স্থানীয় দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের, বিশেষ করে মেয়েদের খুবই উপকার হবে। শুরু থেকে আজ পযন্ত যারা উচ্চ বিদ্যালয়টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা আছেন সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ।

লেখক : গোবিন্দ চন্দ্র বাড়ৈ