এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। গত বছরের চেয়ে পাসের হার কমেছে ৫.৭ শতাংশ আর জিপিএ-৫ কমেছে ৮৬ হাজার। অন্যান্য কিছু সূচকেও নেতিবাচক ফল হয়েছে এবার। ফলাফলের এ অবনমনের কারণ কী তা খতিয়ে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রাথমিকভাবে ৫টি কারণ চিহ্নিত করেছে শিক্ষাবোর্ডগুলো।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের এসএসসিতে সবগুলো বিষয়ে পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা, গণিত ও ইংরেজিতে খারাপ ফলাফল, মানবিক বিভাগে খারাপ ফল, দুই শিক্ষাবোর্ডের খারাপ ফলাফল এবং করোনার সময় স্টাডি গ্যাপের প্রভাব পড়েছে পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যায়।

অবশ্য শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও শিক্ষামন্ত্রীর দাবি, এই ফলাফল স্বাভাবিক। করোনার আগের বছরগুলো তুলনা করলে দেখা যাবে পাসের হার সাধারণত ৮০ শতাংশের ঘরেই ছিল। মাঝে ২০২১ ও ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাসের হার বেড়েছিল (৯৩.৫৮ শতাংশ)। এর কারণ ছিল সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কম বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া। চলতি বছর আগের মতো স্বাভাবিক নিয়মের পরীক্ষায় ফেরায় ফলাফল ৮০ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে।

শিক্ষাবোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার এসএসসিতে যারা পরীক্ষায় বসেছিল, তারা ২০২১ সালে নবম শ্রেণিতে ছিল। করোনার কারণে ওইসময় শিক্ষাসূচি লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। তখন অর্ধ-বার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নেওয়া হয়েছিল। তখনকার শিক্ষাপঞ্জির ঘাটতি নিয়ে দশম শ্রেণিতে উঠেছিল তারা, যার প্রভাব পড়ে এসএসসির ফলাফলে।

এ বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে ফলাফল একটু কম দেখালেও এটিই মূলত স্বাভাবিক ফল। গত দুই বছরের ফলাফলের চিত্র মূলত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের।’

পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমার ব্যাখ্যায় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘করোনার আগের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখবেন পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটি এমনই ছিল। করোনা মহামারির কারণে ২০২১ ও ২০২২ সালের পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হয়েছিল, তাই শিক্ষার্থীরা এক ধরনের সুবিধা পেয়েছিল। যেটা এবার ছিল না।’

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের এসএসসিতে সবগুলো বিষয়ে পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা, গণিত ও ইংরেজিতে খারাপ ফলাফল, মানবিক বিভাগে খারাপ ফল, দুই শিক্ষাবোর্ডের খারাপ ফলাফল এবং করোনার সময় স্টাডি গ্যাপের প্রভাব পড়েছে পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যায়

করোনার সময়ের প্রভাব এখন পড়েছে

কারোনা মহামারির আগের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সালে গড় পাসের হার ছিল ৭৭.৭৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছিল এক লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন। এর আগের নয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পাসের হার ছিল ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালে পাসের হার ছিল ৮২.২০ শতাংশ। ওই বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল এক লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন। ২০২০ সালে পাসের হার ছিল ৮২.৮৭ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছিল এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন। ২০২১ সালে পাসের হার ছিল ৯৩.৫৮ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিল এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন। ২০২২ সালে পাসের হার ছিল ৮৭.৪৪ ভাগ, জিপিএ-৫ পেয়েছিল দুই লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। এ বছর পাসের হার ৮০.৩৯ ভাগ, জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন।

পাসের হার ও জিপিএ-৫ এর এ চিত্র বলছে করোনার আগে আর পরের বছরগুলোর ফলাফলের চিত্র কাছাকাছি। তাই এবার খারাপ ফল নয় বরং ফলাফলের স্বাভাবিক চিত্র ফিরেছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন, করোনার সময় এই শিক্ষার্থীরা অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে ছিল। তাই তাদের পড়াশোনায় গ্যাপ তৈরি হয়েছিল। এর প্রভাব ফলাফলে পড়েছে।

মানবিক বিভাগে খারাপ ফল

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এবার বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ৯৪.৬ শতাংশ আর ব্যবসায় শিক্ষায় ৮২.২ শতাংশ। সেখানে মানবিকে পাস করেছে মাত্র ৭১.৭২ শতাংশ। মানবিকের এই খারাপ ফলের কারণে সার্বিক ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

মানবিক বিভাগে আট লাখ ১২ হাজার ৬৪ জন অংশ নিয়ে পাস করেছে পাঁচ লাখ ৮২ হাজার ৬৪ জন। ঢাকা বোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার শতকরা ৯৩.৯২ ভাগ, একই বোর্ডে মানবিক বিভাগে পাসের হার ৬২.৫৪ ভাগ।

আন্তঃ শিক্ষাবোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার বলেন, ঢাকা বোর্ডের গণিতের প্রশ্ন কঠিন হওয়ায় মানবিক বিভাগের পরীক্ষার্থীরা ফল খারাপ করেছে। এর প্রভাব পড়েছে সার্বিক পাসের হারে।

শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও শিক্ষামন্ত্রীর দাবি, এই ফলাফল স্বাভাবিক। করোনার আগের বছরগুলো তুলনা করলে দেখা যাবে পাসের হার সাধারণত ৮০ শতাংশের ঘরেই ছিল। মাঝে ২০২১ ও ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাসের হার বেড়েছিল (৯৩.৫৮ শতাংশ)। এর কারণ ছিল সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কম বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া। চলতি বছর আগের মতো স্বাভাবিক নিয়মের পরীক্ষায় ফেরায় ফলাফল ৮০ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে

গণিতে খারাপ ফল

বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আটটি বিষয়- বাংলা, ইংরেজি, পদার্থ, রসায়ন, তথ্য ও প্রযুক্তি, পৌরনীতি এবং হিসাব বিজ্ঞান-এ গড় পাসের হার ৯০ শতাংশের বেশি। বিপরীতে গণিত পাস করেছে মাত্র ৮৩.৭৩ শতাংশ। এটাও সার্বিক ফলাফল খারাপের একটি কারণ।

জানতে চাইলে সিলেট শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. রমা বিজয় সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বোর্ডে গণিত বিষয়ে ১২ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেনি। এরা মূলত মানবিক বিভাগের। মানবিকের মোট ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলে।

দুই শিক্ষা বোর্ডের সার্বিক ফলাফল মন্দ

গত বছরের চেয়ে সবগুলো বোর্ডেই এবার পাসের হার কমেছে। তবে বরিশাল ও কুমিল্লা বোর্ডের অবস্থা একটু বেশিই খারাপ। পাসের হার ও জিপিএ পাঁচের দিক থেকে তারা তলানিতে আছে।

কারণ জানতে চাইলে বরিশাল বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আব্বাস উদ্দিন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাকালীন ব্যাচ কিন্তু পরীক্ষা হয়েছে সব বিষয়ে। শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে প্রস্তুত ছিল না। এ কারণে এবার একটু খারাপ ফল হয়েছে। আশা করি, পরের বছর থেকে ঠিক হয়ে যাবে।

কুমিল্লা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. জামাল নাছের ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর সকল বিষয়ে পরীক্ষা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে আগের বছরের চেয়ে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে। এছাড়া আমার বোর্ডে অনেক স্কুলে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিক্ষক নেই। শিক্ষকদের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। সব মিলিয়ে ফল খারাপ হচ্ছে। আমাদের এ নিয়ে কাজ করতে হবে।

এনএম/জেএস