• রোববার ‘আত্তীকৃত বিধিমালা-২০১৮’ পরিবর্তন নিয়ে কর্মশালা
  • সাত বছরে আত্তীকরণ হয়েছে মাত্র ১৩৩টি কলেজ

২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশের সব উপজেলায় একটি করে বেসরকারি কলেজকে সরকারি করা ‍শুরু হয়। কয়েক ধাপে ৩০৪টি কলেজকে জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু সাত বছরে মাত্র ১৩৩টি কলেজের জনবল আত্তীকরণ (সরকারি) হয়েছে। বাকি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীর চাকরি আত্তীকরণ করা হয়নি।

ফলে কলেজ সরকারি হলেও তারা রয়েছে গেছেন বেসরকারি। এর মধ্যে অনেকে বেসরকারি চাকরিজীবী হিসেবে অবসরে গেছেন। শুধু তাই নয়, যারা আত্তীকরণ হয়েছেন, তাদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও পদমর্যাদায় অবনবন করা হয়েছে। গত সাত বছর ধরে চলা এ অবস্থার কবে নাগাদ সমাধান হবে তা স্পষ্ট করতে পারছিল না সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের নজরে আসার পর তা দ্রুত সমাধান করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেওয়া হয়। এরপরই তোড়জোড় শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই অংশ হিসেবে রোববার (২০ আগস্ট) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ‘আত্তীকৃত বিধিমালা-২০১৮’ সংশোধন করার জন্য একটি ওয়ার্কশপ (কর্মশালা) ডেকেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই সভায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, এনটিআরসিএ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন কলেজের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছে।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. রবিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আত্তীকৃত কলেজের বিধিমালায় শিক্ষকের গ্রেডেশনসহ নানা ধরনের অসংগতি দূর করতে এই কর্মশালা ডাকা হয়েছে। সেখানে সবার মতামত নিয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান করা হবে। এ মন্ত্রণালয়ে নতুন এসেছি, তাই এর বেশি কিছু মন্তব্য করতে পারব না।

শিক্ষক নেতারা জানান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন বিধায় তিনি বিষয়টি জানেন। তিনিই উদ্যোগী হয়ে এই বিধিমালা দ্রুত সংশোধন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ উদ্যোগে তারা আশাবাদী। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে শিক্ষকদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়ছে। তাদের শঙ্কা, নতুন কোনো সরকার এলে এসব জাতীয়করণ হওয়া কলেজের আত্তীকৃত শিক্ষকরা সমস্যায় পড়বেন।

যেসব অসংগতি আছে বিদ্যমান বিধিমালায়

শিক্ষক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, কলেজ সরকারি হওয়ার পর শিক্ষকদের বেতনসহ মর্যাদা বাড়ার কথা থাকলেও হয়েছে উল্টো। বেসরকারি কলেজ থাকাবস্থায় যারা সহকারী অধ্যাপক ছিলেন কিংবা সিনিয়র প্রভাষক ছিলেন তারা ষষ্ঠ গ্রেডে বেতন পেতেন। কিন্তু সরকারি হওয়ার পর চাকরি আত্তীকরণ হওয়ায় তারা চলে গেছেন নবম গ্রেডে। অর্থাৎ যেখান থেকে চাকরি শুরু সেই প্রারম্ভিক ধাপে। শুধু তাই নয়, পদোন্নতি নীতিমালা না হওয়ায় চাকরিজীবনে কোনো পদোন্নতিই পাবেন না। অর্থাৎ চাকরির প্রথম ধাপ নবম গ্রেড থেকেই তাদের অবসরে চলে যেতে হবে।

শুধু শিক্ষক নয়, একই পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন কলেজের লাইব্রেরিয়ানরাও। বেসরকারি থাকাবস্থায় কলেজগুলোতে লাইব্রেরিয়ানরা সপ্তম গ্রেডে বেতন পেলেও সরকারি হওয়ার পর তারা বেতন পাচ্ছেন দশম গ্রেডে। এর ফলে তাদের বেতন কমেছে ১৮ হাজার টাকার বেশি।

আত্তীকরণ হওয়ার পর শিক্ষকরা সম্মান ও আর্থিক দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব বৈষম্য দূর করতে তারা সরকারের নানা মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও সমাধান পাননি। অবশেষে তারা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সাবেক সচিব ও বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে আবেদন করেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে নড়াচড়া শুরু হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নির্দেশে আত্তীকৃত বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

রংপুরের পীরগাছা সরকারি কলেজের প্রভাষক মো. আতাউর রহমান বলেন, কলেজ সরকারি হওয়ার পর যতটা আনন্দ পেয়েছি তার চেয়ে বেশি হতাশ হয়েছি যখন দেখলাম আমাদের গ্রেড অবনবন হয়েছে। শুধু গ্রেড নয়, আর্থিকভাবেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সরকারি হওয়ার পর বেতন কমবে এবং কোনো পদোন্নতিও হবে না– এটার জানার পর আমরা সোচ্চার হয়েছি। রোববার (২০ আগস্ট) আমাদের ডেকেছে। আশা করি, সরকার সমাধান করবে এবং সেই কাজ যেন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হয়, সেই দাবি জানাব।

জানতে চাইলে নতুন সরকারি হওয়া কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি জহুরুল ইসলাম বলেন, বিধিমালা পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিয়েছে, এজন্য সাধুবাদ জানাই। তবে নতুন আইনে যাতে নতুন নতুন ধারা সংযোজন না হয়, সেই দাবি থাকবে।

২১২টি অধ্যক্ষ ও ১৯৩টি উপাধ্যক্ষ পদ শূন্য

আত্তীকৃত বিধিমালায় অসংগতি এবং আত্তীকরণ শেষ না হওয়ায় নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে বর্তমানে সরকারি হওয়া কলেজগুলোতে ২১২টি অধ্যক্ষ ও ১৯৩টি উপাধ্যক্ষ এবং অনেক বিষয়ে শিক্ষক পদ শূন্য রয়েছে। অনেক কলেজে করণিক পদ শূন্য এবং সহায়ক কর্মচারীও কমে গেছে। এতে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিস্থিতি ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম সচল রাখার কোনো উদ্যোগ চোখে না পড়লেও বিসিএস ক্যাডার থেকে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে সংযুক্ত করে পদায়ন করা হচ্ছে।

সাত বছরে আত্তীকরণ হলো মাত্র ১৩৩টি

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ৩০২টি কলেজের মধ্যে সাত বছরে মাত্র ১৩৩টি কলেজের প্রশাসনিক কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ৬৩টি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি সুবিধা পাওয়া শুরু করেছেন। বাকি ১৭১টি কলেজের আত্তীকরণসহ নানা বিষয় সমাধানের জন্য কাগজপত্র সচিব কমিটিতে যাবে। এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরকারি হওয়া কলেজে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের কেন আত্তীকরণ করতে হবে, এমন প্রশ্ন তুলেছে।

এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একজন যুগ্ম সচিব জানান, যে ১৩৩টি কলেজের কাজ শেষ হয়েছে সেগুলো নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে যে কলেজগুলো এখন পেন্ডিং আছে সেগুলোর তথ্য অধিকতর যাচাই করতে বলেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী কোনো কলেজে অনার্স কোর্স চালু করতে হলে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। জাতীয়করণ হওয়া বেশির ভাগ কলেজে এভাবে অনার্স কোর্সের জন্য দেদারসে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। নিয়োগ হওয়া শিক্ষকরা যোগদানের সময় নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়ে বলেছেন, তারা জীবনে কোনোদিন এমপিওভুক্তির দাবি করবেন না। কিন্তু যখন কলেজ সরকারি হয়ে গেল, তারাই সরকারি শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নজরে আসার পর এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জবাব চেয়েছে।

তবে শিক্ষকরা বলছেন, ১৩৩টি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী আত্তীকরণ হওয়ার পর নতুন করে এ ধরনের শর্ত দেওয়া হলে বৈষম্য তৈরি হবে।

এ বিষয়ে সদ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হওয়া অতিরিক্ত সচিব আবদুন নূর মুহম্মদ আল ফিরোজ বলেন, জাতীয়করণ হওয়ার পর শিক্ষকদের গ্রেড কমেছে, পদোন্নতি হবে না– এসব বিষয় আলোচনা করে সংশোধন করার সুযোগ আছে। কিন্তু নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়ে যেসব শিক্ষক চাকরি নিয়েছেন, তারা এখন সরকারি হওয়ার যে দাবি তুলছেন সেটা অযৌক্তিক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যে প্রশ্ন তুলেছে তার সঙ্গে আমিও একমত।

এনএম/এসএসএইচ/