ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক আবু সুফিয়ানের শাস্তির দাবিতে সোমবার দিনভর উত্তপ্ত ছিল বসুন্ধরা ক্যাম্পাস। ঘটনার তদন্তে সেখানে যাওয়া কর্মকর্তাকে ছাত্রীর বাবা-মা ও অন্য শিক্ষকরা জানিয়েছেন ‘চারিত্রিক ত্রুটি’ রয়েছে ওই শিক্ষকের। তারা সবাই তার বিচার দাবি করেছেন।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখার নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে প্রতিষ্ঠানটির ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে।

গত ২৩ আগস্ট ওই শিক্ষার্থীর বাবা তার মেয়েকে যৌন হয়রানি করা হয়েছে উল্লেখ করে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলামের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। বিভাগীয় কমিশনার ঘটনাটি তদন্তে সহকারী কমিশনার আল আমিন হালদারকে দায়িত্ব দেন।

গত শনিবার আল আমিন হালদার ও ভিকারুননিসা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী গিয়েছিলেন ভিকারুননিসার বসুন্ধরা শাখায়। সেখানে তিনি অভিযুক্ত শিক্ষক, ভুক্তভোগী ছাত্রীর বাবা-মা, দিবা শাখার ইনচার্জ এবং সংশ্লিষ্ট ১০ জন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন।

এ সময় অভিযুক্ত শিক্ষক আবু সুফিয়ান কয়েকজন শিক্ষককে তদন্ত কর্মকর্তার সামনেই হুমকি দিয়ে বলেন, ‘বিভাগীয় কমিশনার আমার কিছু করতে পারবে না। আমার হাত তার চেয়ে লম্বা।’

আরও পড়ুন : ভিকারুননিসায় হাসিনা বেগমকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করতে হাইকোর্টের রুল

এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা আল আমিন হালদার উষ্মা প্রকাশ করেন। তবে তিনি তার কাজ চালিয়ে যান। তিনি সবার বক্তব্য শোনেন এবং কিছু কিছু বক্তব্য ভিডিও রেকর্ড করেন।

ভুক্তভোগী ছাত্রীর মা তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেন, ‘ওনাকে (শিক্ষক) আমার নিজের ভাইয়ের মতো সম্মান ও আদর করতাম। তিনি কীভাবে এ কাজ করলেন? এটা আমাকে সারা জীবন কুরে কুরে খাবে’— এই বলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে আমার মেয়ের মধ্যে নানা পরিবর্তন দেখতে পাই। তার মধ্যে হতাশা দেখতে পাই। পরীক্ষায় নম্বর কম পাওয়া দেখে আমার সন্দেহ হয়। কেন এমনটা হচ্ছে খুঁজতে থাকি। একদিন দেখি, মেয়ের মোবাইলে আবু সুফিয়ানের এসএমএস আসে। ওই এসএমএসের ভাষা দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই, বোবা হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল আমি এ দুনিয়াতে নেই— এত অশ্লীল আপত্তিকর ভাষা! কী করব বুঝতে পারছিলাম না।’

আরও পড়ুন : ভিকারু‌ন্নিসার সা‌বেক অধ‌্যক্ষের দুর্নীতি অনুসন্ধা‌নে দুদক

এ সময় বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করেন ভুক্তভোগী ছাত্রীর মা। কাদঁতে কাদঁতে শিক্ষক আবু সুফিয়ানের কঠোর শাস্তি চান তিনি।

একটু স্বাভাবিক হয়ে ছাত্রীর মা বলেন, বিভাগীয় কমিশনারের কাছে অভিযোগ করায় আবু সুফিয়ান আমাদের হুমকি দিয়েছেন। বলেছেন, ‘এসব অভিযোগ করে তার কিছু হবে না। এর আগেও এ ধরনের ঝামেলা হয়েছে। এবার যদি কিছু হয়, তবে আমি আত্মহত্যা করব।’

উপস্থিত শিক্ষকরা তদন্ত কর্মকর্তাকে জানান, ওনার বিরুদ্ধে এর আগেও নানা অভিযোগ উঠেছিল। নানা কারণে এর প্রতিবাদ করতে পারিনি‌। আমরা স্কুলের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য যা যা করা দরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

অভিযুক্ত শিক্ষক আবু সুফিয়ান তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দাবি করেন, তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে। শিক্ষকদের একটি গ্রুপ ওই শাখা থেকে তাকে সরাতে এসব ষড়যন্ত্র করছে।

এসময় তদন্ত কর্মকর্তা আল আমিন হালদার সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে সেদিকে শিক্ষকরা সবাই খেয়াল রাখবেন।

আরও পড়ুন : ভিকারুননিসার এক প্রশ্নপত্রে ৩০ ভুল!

তিনি জানান, তদন্ত প্রতিবেদন বিভাগীয় কমিশনারের কাছে জমা দেওয়া হবে। তারপর বিভাগীয় কমিশনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

আবু সুফিয়ানকে বসুন্ধরা শাখায় চান না সহকর্মীরা 

এদিকে সোমবার অভিযুক্ত শিক্ষক আবু সুফিয়ানের শাস্তির দাবিতে ভিকারুননিসার বসুন্ধরা শাখায় শিক্ষকরা আন্দোলন করেন। তারা আবু সুফিয়ানের সঙ্গে কাজ করবেন না মর্মে নিজেদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে অধ্যক্ষের কাছে জমা দেন। তারা যৌন হয়রানি করা ওই শিক্ষককে অবিলম্বে চাকরিচ্যুত করারও দাবি জানান।

পরে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ভিকারুননিসার প্রধান শাখা বেইলি রোডে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তারা কী চায় তা জানতে চান। ওই শিক্ষকরা সবাই একবাক্যে বলেন, তারা আবু সুফিয়ানের অপসারণ চান। তার বিরুদ্ধে এর আগেও যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু বিচার হয়নি।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) কেকা রায় চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন আছে, এ নিয়ে এখন কথা বলতে বারণ আছে। এসব বিষয়ে আমাদের অবস্থান জিরো টলরেন্স। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। ’

শুধু ছাত্রী নয়, মায়েদেরও টার্গেট করতেন শিক্ষক সুফিয়ান!

ভিকারুননিসার বসুন্ধরা শাখার কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষক আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে ওই স্কুলের প্রাথমিক স্তুরের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। এরপর তাকে অন্য শাখায় বদলি করা হয়। তার বদলি ঠেকাতে শিক্ষার্থীদের দিয়ে আন্দোলন শুরু করান আবু সুফিয়ান। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বসুন্ধরা শাখার ইনচার্জ জগদীশ চন্দ্র পালের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন। বাধ্য হয়ে তার বদলির আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

অভিযুক্ত শিক্ষক আবু সুফিয়ান

বসুন্ধরা দিবা শাখার এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে শুধু ছাত্রী নয়, নারী শিক্ষক ও ছাত্রীদের মায়েদের সঙ্গেও আপত্তিকর আচরণ ও কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগ যখনই সামনে আসত বা কর্তৃপক্ষ আমলে নিতো, তখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামানোর হুমকি দিতেন আবু সুফিয়ান। শিক্ষার্থীরা না বুঝে তার ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোলন শুরু করত।

তিনি আরও জানান, ছাত্রীদের অল্প বয়সী মায়েরা আবু সুফিয়ানের টার্গেটে থাকতেন। তাকে প্রায়ই বসুন্ধরা এলাকায় ছাত্রীর মায়েদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খেতে দেখা যায়। এছাড়া তিনি অনুমতি ছাড়াই শিক্ষার্থীর বাসায় চলে যেতেন। এসব বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে অধ্যক্ষকে জানানো হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর ফলে তিনি আরও সাহস পেয়ে যান।

জানা গেছে, গত বছর অভিযুক্ত শিক্ষক আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পান একই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শাখার এক শিক্ষক। সেই শিক্ষককে অপমান ও হেনস্তার হুমকি দেন আবু সুফিয়ান। ফলে তিনি আর তদন্ত কাজ করেননি।

হুমকি পাওয়া ওই শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি তদন্তের জন্য বসুন্ধরা শাখায় যাচ্ছিলাম। সেখানে গেলে আমি সম্মান নিয়ে ফিরে আসতে পারব না—এমন হুমকি দেওয়া হয়। এরপর আমি মাঝপথ থেকে ফিরে আসি। তার বিরুদ্ধে শুধু ছাত্রী নয়, ছাত্রীদের মায়েদেরও যৌন হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে।’

এ বিষয়ে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, গভর্নিং বডির আশকারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন বেড়েই চলছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠিয়ে বাসায় নিরাপদ থাকতে পারেন না। এসব শিক্ষক নামধারী চরিত্রহীন লম্পট শিক্ষকদের কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যেন অন্যরা দেখে ভয় পায়‌। 

তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আচরণ কেমন হবে, এ নিয়ে একটি নীতিমালা হওয়ার কথা শুনেছি। নীতিমালাটি দ্রুত প্রকাশ করে এর যথাযথ ব্যবহার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে শিক্ষকরা যেন কোচিংয়ের নামে শিক্ষা ব্যবসা বন্ধ করতে হবে।

অভিযুক্ত শিক্ষক প্রত্যাহার

এদিকে, সোমবার বিকেলে জানা গেছে, যৌন হয়রানিতে জাড়িত শিক্ষক আবু সুফিয়ানকে বসুন্ধরা শাখা থেকে প্রত্যাহার করে ভিকারুননিসার প্রধান শাখায় অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

এনএম/এমজে