সংগৃহীত ছবি

সদ্য প্রকাশিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে সন্তুষ্ট না হয়ে খাতা চ্যালেঞ্জ করেন বহু পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে ১১ হাজার ৩৬২ পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। আগে ফেল করেছেন এমন দুই হাজার ২১২ জন পাস করেছেন। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক হাজার ৮১১ জন। এমনকি প্রথমে ফেল করা ৬ জন পরবর্তীতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এত বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর ফল প্রথমবার ‘ভুল’ আসার পেছনে পরীক্ষকদের গাফিলতির বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন তাদের ‘পাকড়াও’ করতে নেমেছে শিক্ষাবোর্ডগুলো।

গত ২৮ আগস্ট এসএসসির ফলাফলের পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করা হয়। এতে অনেক বেশি পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে আসার পর কারণ খুঁজতে শিক্ষাবোর্ডকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর সব বোর্ডের পরীক্ষা শাখাকে ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালের পুনর্নিরীক্ষণের তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়। ইতোমধ্যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন অভিযুক্ত পরীক্ষকদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহে এসব শিক্ষকদের শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বোর্ডের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি এমপিও বন্ধ করা। এছাড়া কালো তালিকাভুক্ত করে সারা জীবন বোর্ডের পরীক্ষা সংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। 

এর আগে, গাফিলতির কারণে ২০১৯ সালে এক হাজার পরীক্ষককে শাস্তির আওতায় আনা হয়। তাদের কালো তালিকাভুক্তির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়। এবারও একই কায়দায় শাস্তি দেওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন >> শিক্ষকের এসএমএসের ভাষা দেখে বোবা হয়ে যাই : ভিকারুননিসা ছাত্রীর মা

জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছর পুনর্নিরীক্ষণে ফল পরিবর্তনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সব বোর্ড থেকে তথ্য চেয়েছি। এরই মধ্যে তথ্য বিশ্লেষণ শুরু করেছি। আশা করি চলতি সপ্তাহে এর কারণ এবং দোষীদের চিহ্নিত করতে পারব।

তিনি বলেন, ‘এবার ফল পরিবর্তনের সংখ্যার সঙ্গে করোনার আগের বছরগুলোর পুনর্নিরীক্ষার ফলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হবে। যদি অস্বাভাবিক কিছু হয়, তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কেস স্টাডি

কামরুন নাহার। চুয়াডাঙ্গা সদরের সরোজগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনি ২০২৩ সালের এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে খাতায় প্রাপ্ত নম্বর সঠিকভাবে যোগ করেননি। প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) শিটে সঠিকভাবে বৃত্ত ভরাট করেননি। ম্যানুয়াল নম্বরপত্রের ঘরে কাটাকাটি ও পাস নম্বরের নিচে আন্ডার লাইন করেন। এ শিক্ষকের দায়িত্ব অবহেলার কারণে বহু পরীক্ষার্থী ফেল করেন। ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জ করে খাতা পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করলে ফেল থেকে পাস করেন অনেকে। অনেকে জিপিএ- ৫ পান। এছাড়া বহু পরীক্ষার্থীর বিভিন্ন গ্রেড পরিবর্তন হয়। 

শুধু কামরুন নাহার নয়, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দ্য ওল্ড কুষ্টিয়া হাই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক মরিয়ম খাতুন, টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার মো. আব্দুল মান্নান, নরসিংদীর আব্দুর রহিম টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক সাদ্দাম খন্দকার, খুলনার আফিল উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ট্রেড ইন্সপেক্টর মো. মোস্তাইন বিল্লাহ, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধর্মপুর এসআইডি স্কুলের শিক্ষক মো. শামসুল আলমসহ বহু শিক্ষক সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন না করায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কারিগরি বোর্ড কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছে।

জানতে চাইলে কারিগরি বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েত উল্লাহ বলেন, শিক্ষকদের ভুলের কারণে শিক্ষার্থীদের খেসারত দিতে হয়। এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অভিযুক্ত শিক্ষকদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, বোর্ডের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি এমপিও বন্ধ করা। এছাড়া কালো তালিকাভুক্ত করে সারা জীবন বোর্ডের পরীক্ষা সংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে।   

যেভাবে দোষীরা চিহ্নিত হবে

ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস জানিয়েছে, পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন হওয়া উত্তরপত্রের চারটি দিক দেখা হয়। এগুলো হলো— উত্তরপত্রে সব প্রশ্নের সঠিকভাবে নম্বর দেওয়া হয়েছে কি না, প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিক রয়েছে কি না, প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর শিটে ওঠানো হয়েছে কি না এবং প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ওএমআর শিটের বৃত্ত ভরাট করা হয়েছে কি না। এসব পরীক্ষা করে পুনর্নিরীক্ষার ফল দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রথমটি বাদে বাকি তিনটি বিষয়ে ভুল করলে শিক্ষকদের চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ হওয়া খাতাগুলো তৃতীয় শিক্ষকদের দিয়ে পুনর্নিরীক্ষণ হয়। পুনর্নিরীক্ষণের সময় পরীক্ষক কী কী ভুল করেছেন, তা মন্তব্যের জায়গায় লিখতে বলা হয়। যেমন- একজন শিক্ষার্থী ৬৪ নম্বর পেয়েছেন কিন্তু পরীক্ষক ভুলে ওএমআর শিটে ৪৬ করে দিলেন। অথবা একজন শিক্ষার্থী আটটি প্রশ্নের উত্তর লিখেছেন, পরীক্ষক খাতা মূল্যায়নের সময় সব প্রশ্নের নম্বর দিয়েছেন কিন্তু এক বা একাধিক উত্তরের নম্বর মোট নম্বরে যোগ করেনি। এসব ‍ভুল মন্তব্যের ঘরে লিখে দিতে হবে। তৃতীয় শিক্ষকদের এসব মন্তব্য ধরে ধরে অভিযুক্ত শিক্ষকদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। পরীক্ষক প্রশ্নের যে নম্বর দিয়েছেন তা পরিবর্তন করা যাবে না।

বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর ফলে কেন পরিবর্তন আসছে— জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে খাতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে ভুলগুলো হচ্ছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, পরীক্ষকরা খাতা মূল্যায়নের পর নম্বরের যোগফলে ভুল করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে উত্তরের নম্বর ঠিক মতো যোগ করা হয় না, এমনকি ওএমআর ফরমে বৃত্ত ভরাট করতে গিয়ে অনেকে ভুল করছেন। এ বিষয়ে পরীক্ষকরা জানান, ভুলের অন্যতম কারণ পরীক্ষা শেষে ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশের তাড়া।

শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা বলছেন, খাতা মূল্যায়নে এ ধরনের ভুলের পেছনে কম সময়ে অধিক খাতা মূল্যায়নই দায়ী। ৬০ দিনে ফল প্রকাশের যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়, এতে পরীক্ষকরা খাতা মূল্যায়নে তাড়াহুড়ো করেন। ফলে ভুলের পরিমাণ দিনদিন বাড়ছে।

মৌলিক বিষয়ে বেশি ভুল 

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড বলছে, এর আগে ভুলের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায় যে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তির মতো কমন বিষয়ে ভুল বেশি হচ্ছে। এজন্য পরীক্ষক সংকট ও স্বল্প সময়ে খাতা মূল্যায়নই দায়ী।

জানতে চাইলে আন্তঃবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আবুল বাশার বলেন, বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসা শাখার শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, আইসিটির মতো বিষয় সবার জন্য বাধ্যতামূলক। তার মানে এসব বিষয়ে খাতা বেশি কিন্তু যোগ্য পরীক্ষক কম। বাধ্য হয়ে একজন পরীক্ষককে ৫০০ থেকে ৬০০ খাতা মূল্যায়নে সময় দেওয়া হয় ১০ থেকে ১২ দিন। এ কারণে তারা তাড়াহুড়ো করেন। ফলে ভুলগুলো বেশি হচ্ছে। তারপরও কোনো ভুল ক্ষমার যোগ্য নয়। এ ছাড়া অনেক শিক্ষক শেষ সময়ে এসে খাতার মূল্যায়ন শুরু করেন। এ কারণেও ভুল বেশি হচ্ছে।

যেসব শাস্তির মুখে পড়বেন পরীক্ষকরা

চিহ্নিত পরীক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তির দেওয়ার বিধান রয়েছে। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে। সাধারণত অভিযুক্ত বেশির ভাগ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। অপরাধের মাত্রা বেশি হলে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করার জন্য মন্ত্রণালয়কে বোর্ড সুপারিশ করে। 

একজন পরীক্ষককে শাস্তির দেওয়ার আগে তার বিগত তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। অপরাধের ধরনের ধারাবাহিকতা থাকলে তাকে স্থায়ী কালো তালিকাভুক্ত, কম হলে এক থেকে পাঁচ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবুল বাশার ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিহ্নিত পরীক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী এ ব্যবস্থা তারা নিয়ে থাকেন। সাধারণত অভিযুক্ত বেশির ভাগ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। অপরাধের মাত্রা বেশি হলে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়ে থাকে।

এনএম/জেডএস/