অনলাইনে শিশু শিক্ষার্থীদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মাধ্যমে সরকারি শিক্ষাক্রম বা সিলেবাসের পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছে ‘চলপড়ি’। স্কুলগামী শিশুরা চলপড়ির মাধ্যমে মজার মজার অডিও-ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট ও রংবেরঙের ছবিওয়ালা বইয়ের মাধ্যমে তাদের ক্লাসের পড়া ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।

ইংরেজি ও গণিত বিষয় নিয়ে অভিভাবক ও শিশুদের সহায়তার জন্যই ২০২০ সালে যাত্রা শুরু করে চলপড়ি নামের অ্যাপটি। সরকারি শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পড়াশুনার ব্যবস্থা করে শিশু ও অভিভাবকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই অনলাইন প্ল্যাটফরমটি।

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় চলপড়ির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেরীন মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে। এসময় শিশুদের আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনার এই প্ল্যাটফর্মটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন তিনি।

চলপড়ির টিম/ ছবি ঢাকা পোস্ট

জেরীন মাহমুদ বলেন, প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো, একসঙ্গে হোমওয়ার্ক করা, গল্পের বই পড়া আমার খুবই পছন্দের। সারাটা দিন আমি ঠিক ওই সময়েরই অপেক্ষা করি। কিন্তু একবার ওর সঙ্গে পড়তে গিয়ে আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। আমার ছেলে তখন প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। আমি দেখলাম ও গণিতটা ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। বই পড়ার সময়ও ওর খুবই সমস্যা হচ্ছে। মা হিসেবে বিষয়টা তো আমার জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তার হয়ে দাঁড়াল! এরপরই আমি শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে ওর পড়ালেখায় সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বেশ কিছু ডিজিটাল, মাল্টিমিডিয়া শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করতে শুরু করলাম। সেগুলো ব্যবহার শুরু করতেই ও পড়ার মাঝে আবার আনন্দ খুঁজে পেতে লাগল। গণিত আর বইয়ের লেখা পড়তে পারার সমস্যাটাও আস্তে আস্তে দূর হয়ে গেল। সেসময় আমি দেশের বেশ কিছু সুবিধাবঞ্চিত স্কুলে একটা রিডিং ফেলোশিপ পরিচালনা করছিলাম। সেখানেও দেখলাম, শিশুরা তাদের ক্লাসের বইও ঠিকমতো পড়তে পারছে না। গণিত আর ইংরেজি শিখতেও অনেক পিছিয়ে আছে ওরা। তখনই মাথায় চিন্তা এলো, আমার মতো আরও অনেক মা-বাবারাই তাহলে তাদের সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে এমন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।

তখনই আমরা শিশু ও অভিভাবকদের জন্য এমন কিছু করার পরিকল্পনা করি। তবে আমাদের মাথায় ছিল যেন শিশুরা নিজেদের বোর্ডের বইয়ের অধ্যায় অনুযায়ী পড়াশুনা করতে পারে। সেই অনুযায়ীই করা হয়েছে।

তিনি বলেন, শিশুদের পড়াশুনার ধরন একেকজনের একেকরকম। এই যেমন কোনো কোনো শিশু অ্যানিমেটেড ভিডিও দেখে ক্লাসের পড়া সবচেয়ে ভালো শিখতে পারে। চলপড়ি’তে সেই সুযোগ আমরা রেখেছি। যে শিশু গানের তালে তালে কিংবা গল্পে গল্পে ক্লাসের কোনো পড়া শিখতে পছন্দ করে, তার জন্য সেভাবেই শেখার সুযোগ তৈরির জন্য কাজ করছি আমরা।

২০২২ সালে যখন নতুন শিক্ষাক্রম ঘোষণা...

২০২২ সালে দেশে নতুন শিক্ষাক্রমের ঘোষণা আসে। সেটা পড়তে গিয়েই নড়েচড়ে বসলাম আমি। দেখলাম, চলপড়ি-তে শিশুদের শেখার জন্য যে পরিবেশ আমরা তৈরি করেছি, এবার ঠিক তেমনই একটি পরিবেশ পেতে চলেছে সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। চলপড়ি’র মতোই এই শিক্ষাক্রমে অযথা প্রতিযোগিতার বদলে একে অপরকে সহযোগিতার মাধ্যমে ক্লাসের পড়া শেখার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো করার বদলে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি। নতুন এই শিক্ষাক্রমটি এতটাই যুগোপযোগী ও আধুনিক যে, একে তুলনা করা হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে। সেখানেও প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় হওয়া প্রতিযোগিতা নেই শিশুদের মাঝে। বরং তারা শেখে আনন্দে, নিজের মতো করে। যেমনটা আমরা ২০২০ সাল থেকেই চর্চা করছি চলপড়ি’তে।

যেভাবে আনন্দ নিয়ে পড়ায় চলপড়ি

ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেরীন মাহমুদ হোসেন জানান, চলপড়ি’তে কিন্তু এনসিটিবি বইয়ের ভিত্তিতে তৈরি পাঠই অনুসরণ করা হয়। শিশুরা এগুলো শেখে বিভিন্ন অ্যানিমেটেড ক্যারেক্টারের মাধ্যমে। কাঁঠাল, রোবট, মেঘ, মেঘ মামা, চলপড়ি’র শিক্ষক মিস পেঁচার মতো অ্যানিমেটেড ক্যারেক্টারগুলো শিশুর পড়ালেখাকে করে তোলে আনন্দের। এতে করে সে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় নিজের উৎসাহেই ক্লাসের পড়া শিখে ফেলে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, চলপড়ি’র শিক্ষা উপকরণগুলো শিক্ষকরাও ব্যবহার করতে পারবেন।

তিনি বলেন, চলপড়ি’তে আমরা রেখেছি রংবেরঙের ছবিওয়ালা বইয়ে ভরা ডিজিটাল লাইব্রেরি ‘বইঘর’। এখানে আছে সব বয়সের শিশুদের উপযোগী বাংলা ও ইংরেজি বই। যারা মাত্র পড়তে শিখছে, তাদের উপযোগী বই আছে বইঘরে। আবার যারা পড়া শিখে ফেলেছে, তাদের ভাষা দক্ষতাকে আরও বাড়ানোর উপযোগী বইও আছে এখানে। রিড অ্যালাউড ও হাইলাইটিং ফিচারসম্পন্ন এই বইগুলো শিশুর পড়ার দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তার মাঝে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করে, বিকাশ ঘটায় তার কল্পনাশক্তির। তাই শিশুর জন্য উপযোগী শিক্ষামূলক বইয়ের সন্ধানে যে অভিভাবকেরা রয়েছেন, চলপড়ি’র বইঘর তাদের জন্য একটি আদর্শ জায়গা হতে পারে।

মিস পেঁচার সাথে ক্লাসের পড়া আর বইঘরের বই থেকে শিশু কতটুকু শিখছে, তা যাচাই করার জন্য প্র্যাকটিসের সুযোগও আছে চলপড়ি’তে। এই প্র্যাকটিসগুলোতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে শিশুর আনন্দের সঙ্গে শেখার বিষয়টিকে। এ কারণেই চলপড়ি’র প্র্যাকটিস শিশুর ওপর কোনো চাপ তৈরি করে না, বরং বাড়ায় ওর শেখার প্রতি আগ্রহ। বর্তমানে চলপড়ি’তে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির জন্য পাঠ ও প্র্যাকটিস রয়েছে। বইঘরের বইগুলো পড়তে পারবে সব বয়সী শিশুরাই। আর এখন নতুন শিক্ষাক্রমের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ৬ষ্ঠ শ্রেণির জন্যও পাঠ ও প্র্যাকটিস তৈরির কাজ করছি আমরা, যা ২০২৪ সাল থেকেই চলপড়ি ওয়েবসাইট www.cholpori.com এ পাওয়া যাবে।

চলপড়ির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেরীন মাহমুদ হোসেন/ ছবি ঢাকা পোস্ট

চলপড়ি’র মধ্য দিয়ে আমরা এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চেয়েছি, যেখানে জাতীয় পাঠ্যক্রমের অধীনে থাকা বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি শিক্ষার্থী আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারবে। আমার সন্তানের মতোই দেশের প্রতিটি শিশু মজার মজার সব শিক্ষা উপকরণের সাহায্যে অর্জন করবে নানা দক্ষতা। চলপড়ি ব্যবহার করে একজন অভিভাবক যেমন তার সন্তানকে বাড়িতে শেখার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারবেন, তেমনি চলপড়ি’র মাল্টিমিডিয়া পাঠ, প্র্যাকটিস, পডকাস্ট ও বই ব্যবহার করে একজন শিক্ষকও তার ক্লাসের পড়ায় নতুন প্রাণসঞ্চার করতে পারবেন। এমন সব লক্ষ্য নিয়েই চলপড়ি’র জন্ম, চলপড়ি’র জন্ম এমন একটি সুযোগ তৈরি করার জন্য, যেখানে শিশু শিখতে পারবে নিজের মতো করে।

এসআই/এমএ