‘পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ক্যাডার বিলুপ্ত করার চেষ্টা চলছে’
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেছেন, পরিকল্পিতভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মাধ্যমে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা সরকারবিরোধী আমলারা এক্ষেত্রে মূল নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছেন।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
বিজ্ঞাপন
প্রফেসর শাহেদ বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডারে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন, সুপার নিউমারারি পদে পদোন্নতি, অধ্যাপক পদ তৃতীয় গ্রেডে উন্নীতকরণ, অর্জিত ছুটি প্রদান, ক্যাডার কম্পোজিশনের সুরক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগ বিধি বাতিল, শিক্ষা ক্যাডার তফসিলভুক্ত পদ থেকে শিক্ষা ক্যাডার বহির্ভূতদের প্রত্যাহার ও প্রয়োজনীয় পদ সৃজনসহ নানান দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানানো হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল কোনো ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ক্যাডারের অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাই সারা দেশের সরকারি কলেজে তিন দিনের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।’
এই সময়ে কর্ম বিরতির প্রাসঙ্গিকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এর আগেও আমরা বিভিন্ন কর্মসূচিতে গিয়েছি। তবে এবারের প্রসঙ্গটি একটু ভিন্ন৷ এমন কর্মসূচি দিতে আমরা বাধ্য হয়েছি৷ বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিস রয়েছে এবং সিভিল সার্ভিসে ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে৷ ক্যাডার সার্ভিসের অন্যতম একটি ক্যাডার হলো বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার৷ এটি সৃষ্টির পর থেকেই নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে৷ সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের এই সার্ভিসটিকে ধাপে ধাপে বিলুপ্ত করার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ আমাদের কাছে মনে হয়েছে আমাদের অস্তিত্বটা এবার বিপন্ন হচ্ছে৷ সেজন্য আমাদের এই অবস্থান নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই৷’
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
শিক্ষা ক্যাডারে কী ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে জানতে চাইলে উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, ‘বিভিন্ন ক্যাডারগুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য আছে যেগুলো সংবিধানের পরিপন্থি। কেননা সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা তাদের যোগ্যতা এবং দক্ষতা অনুযায়ী এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হবেন৷ কিন্তু আমরা দেখেছি আমাদের শিক্ষা ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের দীর্ঘদিনের বৈষম্য রয়েছে৷ সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই বৈষম্য দূর করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন৷ কিন্তু এরপরও এই বৈষম্য দূর না হয়ে দিন-দিন আরও বাড়ছে৷ আমাদের কাছে মনে হয়েছে প্রশাসনের মধ্যে রাষ্ট্রবিরোধী এবং দেশবিরোধী চক্র রয়ে গেছে৷ বাংলাদেশে অগ্রগতি ব্যাহত করার জন্য এই বৈষম্য করে রাখা হচ্ছে৷ পেশাজীবীদের মধ্যে বৈষম্য থাকলে অনেকে পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন৷ মেধাবীরা যদি পেশার প্রতি আগ্রহ হারান তাহলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
এমন বৈষম্যের কারণে নতুনরা শিক্ষা ক্যাডারে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের পেশায় যারা নতুন আসছেন তারা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে আসেন৷ কিন্তু যখন দেখতে পান এই সার্ভিসে নানা বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে তখন তারা এখান থেকে চলে যান৷ এর ফলে মূল ক্ষতিটা শিক্ষার জন্য হচ্ছে৷ আমাদের যে সাংবিধানিক মর্যাদা রয়েছে এবং অধিকার রয়েছে, সেই অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি৷ এজন্য আমাদের কাছে মনে হয়েছে যে, আমাদের পূর্ণ শক্তি দিয়ে কাজ করতে হবে৷ এজন্য আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে এ ধরনের কর্মসূচি দিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রীর করে দেওয়া কমিটিকে তোয়াক্কা করেনি আমলারা— এমনটি উল্লেখ করে প্রফেসর শাহেদ বলেন, ‘২০১৫ সালে পে-স্কেলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাডার হলো শিক্ষা ক্যাডার৷ এটি প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর পরে তিনি দুইটি কমিটি করে দিয়েছিলেন। এই কমিটির কাজ ছিল ক্যাডারদের মধ্যে বৈষম্য দূর করা। সেই কমিটি যে সুপারিশ করেছিল সেই সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়ন হয়নি৷ ফলে যেখানে অন্যান্য ক্যাডারের তৃতীয়, দ্বিতীয়, এবং প্রথম গ্রেডের পদ সৃজন হচ্ছে, সেখানে আমাদের ক্যাডার কর্মকর্তারা চতুর্থ গ্রেডে থেকে যাচ্ছেন৷ এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার একটি অংশ। প্রশাসনে যেসব সরকারবিরোধী ঘাপটি মেরে বসে আছেন, তারা নানান উপায়ে সার্ভিসটাকে বৈষম্যের শিকার করে রেখেছেন।’
‘প্রধানমন্ত্রী বলছেন বৈষম্য দূর করার জন্য, অথচ সেখানে বৈষম্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আমাদের প্রাথমিক থেকে উচ্চ স্তর পর্যন্ত সর্বস্তরের শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে৷ এটি সুপরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে৷ কেননা শিক্ষকের ঘাটতি হলে শিক্ষার মান হ্রাস পাবে। আর শিক্ষার মান যদি হ্রাস পায় তাহলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র যেভাবে অগ্রগতির কথা চিন্তা করছে, যে লক্ষ্য স্থির করেছে... সেপি ব্যাহত হবে৷’
প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে বড় খেসারত দিতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার যে দৈন্যদশা, এটি হয়েছে ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে৷ আমরা দেখেছি অস্বাভাবিকভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে যেটা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণের জন্য সম্পূর্ণ পরিপন্থি৷ এটা আমলারা পরিচালনা করছেন বলে এমনটা হচ্ছে৷ আমাদের প্রাথমিকের সঙ্গে সঙ্গে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার পুরো পরিবেশ খণ্ড-বিখণ্ড করা হচ্ছে। ফলে বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত আসছে৷ আমাদের অবস্থান হচ্ছে এই জায়গাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষা ক্যাডারকে নেতৃত্ব দিতে হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সব ধরনের প্রশাসনিক দায়িত্ব শিক্ষা ক্যাডারের হাতেই দিতে হবে।
সর্বাত্মক কর্ম বিরতির বিষয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি বলেন, ‘আজ থেকে তিন দিনের কর্মসূচি শুরু হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা কোথাও কেউ কাজ করবেন না৷ যে যেখানে থাকুক না কেন কোনো কাজ করবেন না৷ আমরা আমাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চাই। আর আমাদের দাবিগুলো যৌক্তিক। এমন একটি দাবিও পাবেন না যেখানে বাড়াবাড়ি করা হয়েছে।’ শিক্ষা ক্যাডার দ্বারা শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনা করা না হলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে বলেও জানান তিনি।
আরএইচটি/কেএ