বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে পৃথক দুটি নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

শিক্ষক কর্মকারী নিয়োগ-পদোন্নতির জন্য ‘অভিন্ন শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালা’ এবং আর্থিক ব্যয় নির্ধারণে ‘অভিন্ন আর্থিক নীতিমালা’ করতে চায় সংস্থাটি। একই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা আইন ২০১০ পরিবর্তন করার সুপারিশ করেছে তারা। সংস্থাটি সর্বশেষ ৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদন এসব সুপারিশ করা হয়েছে।

২৭ ডিসেম্বর (রোববার) বঙ্গভবনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের কাছে হস্তান্তর করেছে ইউজিসি। কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহসহ কমিশনের সদস্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সংসদের আসন্ন অধিবেশনে এটি উপস্থাপনের কথা রয়েছে।

তিন বছর আগে ইউজিসি শিক্ষক-কমচারী নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালার খসড়া করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একাধিক ওয়ার্কশপ করার পর তা প্রায় চূড়ান্ত করলেও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাধায় সেটি আটকে গেছে। এবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য ও সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছে ইউজিসি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভিন্ন ভিন্ন আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে। যে কারণে ৭৩ অধ্যাদেশ/আইনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাড়া অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি ‘আ¤্রলো অ্যাক্ট’ এর মাধ্যমে পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে।ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি/পদোন্নয়নের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণী নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করে বলা হয়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি/পদোন্নয়নের জন্য একটি অভিন্ন নীতিমালা ইউজিসি উদ্যোগ নিতে পারে।     

এছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মধ্যে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি বিধি-বিধান অমান্য করে আর্থিক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিসিসহ ঊর্ধ্বতন কর্তা ব্যক্তিরা এসব অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ভিসিরা সরকারের বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য থাকায় ইউজিসি তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি অভিন্ন আর্থিক নীতিমান করার উদ্যোগ নেয় ২০১২ সালে। ইউজিসি এ সংক্রান্ত একটি খসড়া নীতিমালা করেও বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাধার মুখে সেটি আলোর মুখ দেখেনি।

প্রতিবেদনে ২৪ দফা সুপারিশ করেছে। এরমধ্যে ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার নিয়োগের ক্ষেত্রে একাডেমিক এক্সেলেন্স, প্রশাসনিক দক্ষতা ও নৈতিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দিয়ে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ইউজিসির মতামত গ্রহণ করতে পারে।

প্রতিবেদনে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শিক্ষা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবিড়-কার্যকরী যোগাযোগ ও সহযোগিতা আশাব্যঞ্জক নয় বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। উচ্চশিক্ষার গুনগত মানোন্নয়নের জন্য বিশ্বের প্রথম সারির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যৌথ গবেষণা-অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে শিক্ষক,গবেষক-শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে উচ্চতার ডিগ্রি অর্জনের জন্য স্কলারশিপ ও ফেলোশিপের সংখ্যা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। এজন্য একটি নীতিমালা করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্পন্ন কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও উচ্চশিক্ষায় নারী-পুরুষের সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত কল্পে কাজ করতে হবে। এসডিজি-৪ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শিক্ষা খাতে ইউনেস্কোর সুপারিশ বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক আইসিটি সমৃদ্ধ তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি এবং তাদের মূল্যায়ন রিপোর্ট ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল অন্যান্য প্রক্রিয়ায় অভিভাবকদের নিয়মিত জানাতে বলা হয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণা সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েব সাইটে প্রকাশে সরকারের নির্দেশনা সুপারিশ করা হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে দেশের বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে ইন্টিগ্রেটেড ইউনিভার্সিটি ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট প্লাটফর্ম তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইআরপি সফটওয়ার প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে কাজের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিল্প, পেশাগত সংস্থা ও কমিউনিটির সংযোগ এবং শিল্প সংস্থার প্রতিনিধিদের কারিক্যুলাম কমিটিতে যুক্ত করে একাডেমিক প্রোগ্রাম যুগপোযোগী করা খুব জরুরি বলে মনে ইউজিসি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষক তৈরি করতে ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি, উন্নত গবেষণা করার জন্য সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও গবেষণার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্য ন্যাশনার রিসার্চ কাউন্সিল স্থাপন জরুরি। ইউজিসির অধীনে এ তিনটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। গবেষণার চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে কোনো নীতিমালা নেই। গবেষণার মান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য সফটওয়ার তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কলেজ এবং মাদ্রাসায় মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। ৭৩’ অধ্যাদেশ/আইনের অধীনস্থ ছাড়া অন্য সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির আওতায় নিয়ে আসার সুপারিশ করা হয়েছে।  

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে পাবলিক ও বেসরকারি মিলে ১৫১ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তদারকি করতে যে আইনি ক্ষমতা দরকার তা বিদ্যমান আইনে সম্ভব না। একই সঙ্গে উচ্চশিক্ষার পরিধি ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউজিসির বর্তমান অবকাঠামো এবং জনবল দিয়ে সামগ্রিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চ শিক্ষার সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা-গবেষণা নিশ্চিত করতে আর্থিক বরাদ্দ ও অবকাঠামো সুযোগ সুবিধাসহ আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি বলে সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, ইউজিসির ৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষার বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও করণীয় সম্পর্কে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালা করা। যেটি প্রতিবেদনে ইতোমধ্যে আমরা সুপারিশ করেছি। তার নানা সুপারিশগুলোর ব্যাপারে সে আমরা পদক্ষেপ নেব। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মধ্যে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি বিধি বিধানকে অমান্য করছে। 

এ কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি অভিন্ন আর্থিক নীতিমালা করতে হবে। সাক্ষাৎকালে রাষ্ট্রপতিও কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন বলে ইউজিসি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অ্যাপেক্সবডি ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ২০১৯ সালের কার্যক্রমের ওপর এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ৫৬৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ২৪টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে ৪৬টি সরকারি ও ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য স্থান পেয়েছে।

বেসরসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন নিশ্চিত করতে আইন-২০১০ যুগোপযোগী করাসহ শিক্ষক,কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপযুক্ত বেতন কাঠামো এবং চাকরি বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। শতকরা তিন শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও অসচ্ছল দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষর্থীদের বিনা বেতনে অধ্যায়ন সুযোগ নিশ্চিত করতে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে নীতিমালা করে করেও আওতাভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। একই জেলায় একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া বন্ধের সুপারিশ করেছে ইউজিসি।

সান্ধ্যকালীন, উইকঅ্যান্ড, এক্সিকিউটিভ এ ধরনের কোর্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। যে কারণে এসব কোর্চ বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে ইউজিসির অনুমোদ নিয়ে ডিপ্লোমা, শর্ট কোর্স, ভোকেশনাল, ট্রেনিং প্রোগ্রাম খণ্ডকালীন স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম পরিচালনা করতে পারবে।

এ ক্ষেত্রে নীতিমাল প্রণয়ন করতে প্রয়োজনে নির্দেশনা দিতে পারবে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে ভর্তির নির্দেশিকা তৈরি, কারিক্যুলাম প্রণয়ন ও ভিন্নভাবে পরীক্ষা নিয়ে সুরক্ষার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে কোটা নির্ধারণে সুপারিশ করেছে ইউজিসি।  

দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে ফলাফল নির্ভর শিক্ষাকাঠামো গড়ে তুলতে ইউজিসি কর্তৃক আউটকাম বেইজড এডুকেশন কারিক্যুলাম টেমপ্লেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশনার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া দ্রুত অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চলমান প্রোগ্রামগুলোর অ্যাক্রিডিট করার সুপারিশ করা হয়েছে। 

এনএম/এসএম