নোট গাইড/ ফাইল ছবি

প্রায় ১১ বছর ঝুলে থাকার পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে বহু প্রত্যাশিত ‘শিক্ষা আইন’র খসড়া চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। এ আইনে নোট-গাইড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শর্তসাপেক্ষে বৈধতা দেওয়া হয়েছে ‘সহায়ক বই’কে। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের কোচিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও সরকারের কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়ে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টার চালানো যাবে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বা ইংরেজিসহ ভাষাশিক্ষার সেন্টারকেও নিতে হবে নিবন্ধন। এমন সব ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে ‘শিক্ষা আইন- ২০২১’-এ।

আইনটি মন্ত্রিপরিষদে পাঠানোর আগে ১৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মত চাওয়া হয়। এর মধ্যে ৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোচিং-নোট গাইডের বৈধতার প্রস্তাবে আপত্তি তুলেছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট নিষিদ্ধ করে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাবে বেঁকে বসেছে। এক্ষেত্রে জনপ্রশাসন, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাইভেট নিষিদ্ধ করে অতিরিক্ত ক্লাসের প্রস্তাব করে শিক্ষকদের বাড়তি শ্রমের জন্য বিশেষ ভাতা (শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে) চালুর মত দিয়েছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম ডিগ্রি পাস করার প্রস্তাব করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। এভাবে ছয়টি মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের বিভিন্ন ধারা-উপধারার ওপর মতামত দিয়েছে।

এসব মতামতের ওপর আলোচনা করেতে আজ সোমবার (১৯ এ্রপ্রিল) দুপুরে এক ভার্চুয়াল সভার আয়োজন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। সভায় ১৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নেতৃত্বে আরেকটি সভা করে আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামতের বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) খালেদা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যেসব মতামত পেয়েছি, সেগুলো নিয়ে সভায় আলোচনা করা হবে। আমাদের মন্ত্রী মহোদয় সভায় উপস্থিত থাকবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আলোচনার আগেই বলা যাচ্ছে না মতামতগুলো আইনের খসড়ায় সংযুক্ত করা হবে কি না।

জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রণয়ন করা ‘শিক্ষা আইন-২০২১’ খসড়াটির ওপর আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়ার জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, অর্থ বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এর মধ্যে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মতামত পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। ভূমি মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় খসড়া আইনটির সঙ্গে শতভাগ সহমত প্রকাশ করেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় বেশ কিছু ধারা-উপধারার ওপর গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছে।

খসড়া শিক্ষা আইনের ২৬ উপধারায় কোচিং, প্রাইভেট টিউশনির বিষয়ে বলা হয়েছে- (১) কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট/টিউশনের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না; তবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের লিখিত সম্মতি সাপেক্ষে শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের আগে বা পরে সরকার কর্তৃক প্রণীত বিধি বা নীতিমালা অথবা জারি করা পরিপত্র বা নির্বাহী আদেশ অনুসরণ করে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন।

এ ধারায় কৃষি মন্ত্রণালয় মতামত দিয়েছে- শিক্ষকদের অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট-টিউশনের সুযোগ দিলে তার (শিক্ষক) নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হতে পারে। এক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রাইভেট-টিউশন বন্ধ রেখে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষকদের বাড়তি পরিশ্রমের জন্য বিশেষ ভাতা (যা শিক্ষার্থীরা পরিশোধ করবে) চালুর মত দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

খসড়া আইনে নিবন্ধন ছাড়া সব ধরনের কোচিং সেন্টার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া একই কোচিং সেন্টারে দেশি শিক্ষাক্রম ও বিদেশি শিক্ষাক্রমের পাঠদান করা যাবে না বলা হয়েছে। এ বিধানের লঙ্ঘন করলে কোচিং সেন্টার পরিচালনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ধারার ওপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বলেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলাকালীন সময় সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কোনো কোচিং সেন্টার খোলা রাখা বা পরিচালনা করা যাবে না। এছাড়া প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও জুনিয়র ক্লাস পর্যায়ে দৈনন্দিন জীবনের আচরণগত শিক্ষা (যেমন-পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শিষ্টাচার, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

খসড়া আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ধারার ৬ নং উপধারায় (২) বলা হয়েছে, সরকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পর্যায়ক্রমে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা চালু করবে। কৃষি মন্ত্রণালয় এ ধারায় মতামতে উল্লেখ করেছে- প্রাথমিক স্তরের পরে ‘যথা সম্ভব’ যোগ করা যেতে পারে। কারণ অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ও নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার লেখ্যরূপ নেই।

খসড়ার চতুর্থ অধ্যায়ের ১০ ধারায় বলা হয়েছে, আনুষ্ঠানিক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক পদ্ধতির কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার যথাযথ স্বীকৃতি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। এ ধারার ওপর কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ - ‘কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের যথাযথ স্বীকৃতি’ যুক্ত করতে মতামত দিয়েছে।

পঞ্চম অধ্যায়ে ১৩ ধারার ২ উপধারায় ‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল ধারায় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বাধ্যতামূলক হইবে’ বলা হয়েছে। এখানে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ ওই বাক্যের সঙ্গে ‘তবে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নিয়ে প্রয়োজনানুসারে সমন্বয় করা যাইবে’ যুক্ত করতে মত দিয়েছে।

খসড়া আইনের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৮ উপধারায় ৫ নং প্যারায় বলা হয়েছে, ‘পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনে পরীক্ষার্থীদের সহায়তা করা বা পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করার যেকোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতা দণ্ডনীয় অপরাধ হইবে।’ এখানে কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে - ‘উল্লিখিত বিষয়াদি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হইবে এবং নীতিমালায় বর্ণিত দণ্ডে দণ্ডিত হইবে’। দণ্ডের পাশাপাশি অভিযুক্ত ছাত্র/ছাত্রী নির্দিষ্ট সময়ের (২/৩ বছর) জন্য পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার শর্ত যুক্ত করতে মত দিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়। একই ধারার ওপর কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ মতামত দিয়েছে- ‘নতুন অনুচ্ছেদ (৭) পরীক্ষা অনুষ্ঠানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক, কক্ষ পর্যবেক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ফৌজদারি অপরাধের নিষ্পত্তি দ্রুত বিচার আইনে সম্পন্ন করা হইবে এবং জামিন অযোগ্য হইবে’।

খসড়া আইনের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ২০ উপধারায় শিক্ষক-প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ মতামত দিয়ে বলেছে, ‘নতুন অনুচ্ছেদ (২) সকল স্তরের শিক্ষক ও প্রশিক্ষকগণের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যোগদানের পর ওরিয়েন্টেশন প্রশিক্ষণ এবং পরবর্তীতে কারিকুলাম অনুসারে নিয়মিত ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করে বিধিমালা প্রণয়নও বিদ্যমান বিধিবিধানের সংশোধনী আনয়ন করিবে’।

খসড়া আইনের ২২ উপধারার (ঘ) অনুচ্ছেদে শিক্ষকদের অযোগ্যতার বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, ‘কোনো শিক্ষকের শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষমতার বিষয়টি কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রত্যয়িত হইতে হইবে’। এক্ষেত্রে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের বর্ণনা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। একই ধারার (২) অনুচ্ছেদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি ও পরিচালনা কমিটির সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম ডিগ্রি পাস হতে হবে।’

এছাড়া খসড়া আইনে বেতন, টিউশন ফি, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সনসহ বিদেশি শিক্ষাক্রমে পরিচালিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন, টিউশন ও অন্যান্য ফিস আদায়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন হার সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে বলা হয়েছে।

খসড়া আইনের নবম অধ্যায়ে বিবিধের ৩৭ উপধারার ‘শারীরিক শাস্তি ও মানসিক নিপীড়ন’ এর বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘কোনো শিক্ষক সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে কোনো প্রকার শারীরিক শাস্তি প্রদান বা মানসিক নিপীড়ন করবেন না।’ এখানে কৃষি মন্ত্রণালয় ‘শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধি বিকাশ এবং প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা রক্ষার্থে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীকে শোভনীয়ভাবে শাসন করতে পারবেন’ - যুক্ত করতে মতামত দিয়েছে। কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ ‘শিক্ষকদের ওপর শিক্ষার্থী কর্তৃক সংগঠিত কোনো ফৌজদারি অপরাধের নিষ্পত্তি দ্রুত বিচার আইনে সম্পন্ন করা হবে এবং জামিন অযোগ্য হইবে’ - যুক্ত করতে প্রস্তাব দিয়েছে।

এনএম/এসএসএইচ