নতুন কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে। ২০২১ সালের জন্য নতুন কারিকুলামে তৈরি করা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বই নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছে এনসিটিবি। 

শেষ মুহূর্তে করণীয় ঠিক করতে বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) এনসিটিবির জরুরি বোর্ড সভা হয়। কয়েক কোটি  টাকা খরচের দায় এড়াতে ২৫ এপ্রিল (রোববার) আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডেকেছে এনসিটিবি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

বিষয়টি স্বীকার করে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের ১৮ এপ্রিল একটি চিঠি দিয়েছে। তাতে বিদ্যমান কারিকুলাম অনুযায়ী বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করার জন্য বলেছে। আমরা বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে মৌখিকভাবে জানিয়েছি। ওনারা দুই-একদিনের মধ্যে বসে সিদ্বান্ত দেবেন।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নতুন কারিকুলাম তৈরির উদ্যোগ নেয় সরকার। লক্ষ্য ছিল নতুন কারিকুলামে ২০২০ সাল থেকে প্রাথমিক স্তরের প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ৬ষ্ঠ শ্রেণির বই দিয়ে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হবে। কিন্তু করোনার কারণে তা সম্ভব হয়নি। তাই ২০২১ সালে একসঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ৬ষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামে বই দেওয়া হবে।

অভিযোগ উঠেছে, নতুন কারিকুলাম তৈরি করতে গিয়ে এনসিটিবি পাঠ্যপুস্তক বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থা ও এনজিওর মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে নতুন কারিকুলাম। তাই আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য তৈরি করা নতুন কারিকুলামের বই নেবে না প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিষয়টি চিঠি দিয়ে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) জানিয়ে দিয়েছে।

সূত্র বলছে, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের (পিইডিপি-৪) আওতায় প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের হালনাগাদকরা সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা ২০১৮ সালে অনুমোদন দেয় প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন কারিকুলাম প্রণয়নে দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কারিকুলাম তৈরিতে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। কমিটি কারিকুলাম বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত করে।

কিন্তু হঠাৎ করে আগের রূপ রেখার যোগ্যতা ও শিখন ফল বাদ দিয়ে জটিল একটি যোগ্যতার ছক (মেট্রিক্স) জুড়ে দেওয়া হয়েছে এনসিটিবির পক্ষ থেকে। এতে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদিত প্রাথমিক স্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত উপেক্ষা করে ইউনিসেফ, প্লান বাংলাদেশ ও ব্র্যাকের কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় সমন্বিত শিক্ষাক্রম রূপ রেখাটি তৈরি করা হয়েছে। আর এনসিটিবির প্রাথমিকের উইং প্রধানকে বাদ দিয়ে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মশিউজ্জামানকে।

জানা গেছে, প্রাথমিকের কারিকুলাম এনসিটিবি তৈরি করলেও অনুমোদন দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর বই ছাপার সিডিউল অনুমোদন দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)। চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) অর্থে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের খরচ করা হলেও শিক্ষাক্রম রূপরেখা তৈরিতে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, তিন বছর ধরে দেশের বাস্তবতা যাচাই ও চাহিদা বিবেচনা করে এনসিটিবির বিশেষজ্ঞদের তৈরি করা যোগ্যতাভিত্তিক শিখনফল (লার্নিং আউট কাম) বাদ দিয়ে ‘অভিজ্ঞতা ভিত্তিক’ জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে নতুন কারিকুলামের রূপরেখা তৈরি করা হয়। এনসিটিবির প্রাথমিক উইং এর কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে  রূপ রেখাটি চূড়ান্ত করা হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর নড়ে চড়ে বসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে পুরাতন কারিকুলামে বই ছাপার টেন্ডার ডাকতে বলেছে।

এ অবস্থায় কি করবেন?— জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণচন্দ্র সাহাবলেন, প্রাথমিকে পুরাতন কারিকুলামে বই ছাপালেও মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তমে শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামে বই ছাপানো যেতে পারে।  দুই স্তরের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হবে কিনা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এপ্রিল মাসে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী বই লেখা শুরু করে জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এরমধ্যে লকডাউন শুরু হওয়ায় করতে পারিনি। এ অবস্থা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। তারা আলোচনা করে সিদ্বান্ত দেবেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত পৌঁছেছে। অপরদিকে এনসিটিবির বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে করা রূপরেখা তৈরিতে কয়েক কোটি টাকা হালাল করতে মাধ্যমিক স্তরে বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাথমিক স্তর বাদ দিয়ে মাধ্যমিক স্তরে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হবে।

এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, কারিকুলামের খসড়া দুই মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। এখনও মিটিং করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীকে ফ্রেম ওয়ার্কটা দেখানোর প্রচেষ্টা চলছে। ওই টার জন্য এখনও অনুমোদন হয়নি।

সূত্র জানিয়েছে, এনসিটিবিকে দেওয়া চিঠিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, এখনও আপনারা (এনসিটিবি) কারিকুলাম চূড়ান্ত করতে পারেননি, ফ্রেম ওয়ার্ক অনুমোদন নেননি। ফ্রেম ওয়ার্ক অনুমোদনের পরে কারিকুলামের অনুমোদন নিতে হবে। অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ করে পাঠ্যপুস্তক লেখা জুন মাসের মধ্যে শেষ করতে পারবেন না। টেন্ডার শিডিউল পিছিয়ে যাবে। বছরের প্রথম দিন বই দেওয়া সম্ভব হবে না। এসব কারণ দেখিয়ে পুরাতন কারিকুলামে প্রাথমিকের বই ছাপাতে বলেছে।

ওই চিঠি পেয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান করণীয় নির্ধারণ করতে জরুরি বোর্ড সভা ডাকেন। বোর্ড সভায় উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা জানান, সভায় প্রাথমিকের বই বর্তমান কারিকুলাম অনুযায়ী ছাপানের সিদ্বান্ত হয়। তখন একজন কর্মকর্তা প্রশ্ন তুলেন কারিকুলামের রূপরেখা তৈরিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে। গাজীপুর ও সাভারের বিলাসবহুল রিসোর্টে দিনের পর দিন কর্মশালা করে কোটি টাকা অযথা খরচ করা হয়েছে। মোটা অংকের সম্মানি দেওয়া হয়েছে। এর দায় কে নেবে? তখন বিষয়টি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রোববার আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডাকা হয়েছে।

এনসিটিবির সূত্র জানায়, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে গত বছরের ২ জুন শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ সভায় সিদ্বান্ত হয়েছিল আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তমে শ্রেণির বই নতুন কারিকুলামে বই ছাপানোর। কিন্তু প্রাথমিকের বই পুরতান কারিকুলামে ছাপাতে বলায় বিষয়টি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে জানিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন নীতি নির্ধারক। তখন রোববার দুই মন্ত্রণালয় নিয়ে সভা ডাকে এনসিটিবি।

প্রসঙ্গত,প্রাথমিকেরবই এনসিটিবি ছাপালেও প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষামন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে।  

এনসিটিবিরবোর্ড সভা সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী নতুন কারিকুলাম প্রাথমিকে বাস্তবায়ন না করে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামের বই চালু করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হবে বলে একজন সদস্য সভায় মতামত দেন। এর জবাবে শিক্ষাক্রম রূপরেখা তৈরির প্রধান সমন্বয়ক ও এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মশিউজ্জামান কোনো সমস্যা হবে না বলে দাবি করেন।

তখন অন্য এক সদস্য বলেন, মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামের বই ছাপানোর আগে নিশ্চিত করতে হবে প্রাথমিক স্তরেও একই রূপরেখা অনুযায়ী নতুন কারিকুলামের বই ছাপানো হবে। এটা করতে না পারলে দুই স্তরের মধ্যে ব্যাপক সমস্যা তৈরি হবে। কারণ, দুই স্তরের কারিকুলাম দুই ধাচের হবে। তখন মশিউজ্জামান পিছু হটেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষাক্রমের নতুন রূপরেখায় যোগ্যতাভিত্তিক শিখন ফল বাদ দেওয়া হয়েছে। আর ‘অভিজ্ঞতা ভিত্তিক’ যোগ্যতা যুক্ত করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের সব পাঠই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দিতে হবে। সব কিছু অভিজ্ঞতা দিয়ে হয় না।

অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ ছাড়াই অগোছালোভাবে অভিজ্ঞতাভিত্তিক যোগ্যতাগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। কারিকুলামের রূপরেখার টেমপ্লেটে যোগ্যতাভিত্তিক শিখনফল বাদ দিয়ে সরাসরি বইয়ের কন্টেন্ট লেখার কথা বলা হয়েছে।  এভাবে বইয়ের বিষয়বস্তু লিখলে বই ভারসাম্যহীন হয়ে বড় ধরনের গ্যাপ তৈরি হবে। ওই ঘাটতি পূরণে সহায়ক বই (নোট গাইড), কোচিং-প্রাইভেটের ওপর নির্ভর হয়ে পড়বে শিক্ষার্থীরা। একাধিক সহায়ক বই কিনতে হবে। অথচ শিখনফল প্রাথমিক শিক্ষায় বহু বছর ধরে চর্চা হচ্ছে। শিক্ষকদের সেভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে তোলা হয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতিতে নতুন রূপরেখা বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহরের বিদ্যালয়ের বাস্তবায়ন সম্ভব না।   

এনএম/এসএম