জামালপুরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে চার বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন সরকারের অবসরপ্রাপ্ত একজন অতিরিক্ত সচিব। বৃহস্পতিবার (৬ মে) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সরকারি কর্মকর্তার নাম মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাবেক অতিরিক্ত সচিব। বর্তমানে তিনি অবসরোত্তর (পিআরএল) ছুটিতে আছেন।

একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে একজন আমলাকে নিয়োগ দেওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা এ সমালোচনায় অংশ নিয়েছেন । 

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সাবেক উপাচার্য বিষয়টিকে প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে হলেও শিক্ষকদের জন্য ‘শিক্ষনীয় সিদ্ধান্ত’ বলে মনে করেন। তাদের যুক্তি, সম্প্রতি রাজশাহী ও রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ও আর্থিক কেলেঙ্কারির যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে অন্য পেশা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একাধিক কর্মকর্তা এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি নতুন, এখানে আড়াই হাজার কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হবে। এ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

তাদের মতে, সেখানে জমি অধিগ্রহণ, জমি উন্নয়ন, একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, ছাত্র-ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণসহ নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যা যা প্রয়োজন সব থাকবে। প্রস্তাবনাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। শিগগিরিই একনেকে পাস করার জন্য তোলা হবে। বড় উন্নয়নমূলক এসব প্রকল্পের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একজন দক্ষ কর্মকর্তাকে এ পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকেই আবদুল মান্নানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি আইএমইডিতে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন। প্রকল্প নিয়ে তার ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার এ তিনটি পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য ও রাষ্ট্রপতি। নিয়োগের আগে সম্ভাব্য প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই-বাছাই করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য হওয়ার জন্য একাডেমিক যোগ্যতার প্রয়োজন হলেও ট্রেজারার পদে  একাডেমিক যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। একাডেমিক কোনো যোগ্যতার কথা নিয়োগবিধিতেও বলা নেই। তাই সরকার শিক্ষকদের বাইরের কাউকে এ পদে নিয়োগ দিতে পারবে না- এ ধরনের কোনো কথাও নেই।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার- এ তিনটি পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য রাষ্ট্রপতি। তিনি যাকে ভাল মনে করেছেন তাকেই নিয়োগ দিয়েছেন। তবে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ তিন পদের একটি ট্রেজারার। এ পদে এতদিন শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হতো। ভবিষতেও যেন শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয় সেই প্রত্যাশা করি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেজারার একাডেমিক কোনো পদ না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয় ও আর্থিক বিষয়গুলো তিনি দেখভাল করেন। তাই এ পদে শিক্ষকের বাইরে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না, এটা বলা যাবে না। সরকার যাকে ভাল মনে করেছে তাকে নিয়োগ দিয়েছে। তবে এই পদে শিক্ষকদের মধ্যে থেকে নিয়োগ দেওয়া ছিল ট্র্যাডিশন।

তিনি বলেন, যেহেতু প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে আমলা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাই এখন বিবেচনার সময় এসেছে এটা শিক্ষকদের ওপরে সরকারের আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ কি না। সম্প্রতি রাজশাহী ও রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগসহ আর্থিক অনিয়মের যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে সরকার যদি কোষাধ্যক্ষের বাইরের পদগুলোতেও অন্য পেশার লোকদের এনে বসিয়ে দেয় তাহলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

হারুন অর রশিদ বলেন, শিক্ষকদের মর্যাদা তাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। যেসব দুর্নাম হয়েছে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এই আমলাতান্ত্রিক নিয়োগ যেন ধারাবাহিকতার দিকে না যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে।

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কথা বলতে রাজি হননি। তারা বলেন, আমাদের নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। ট্রেজারারকেও তিনি নিয়োগ দিয়েছন। এটার সমালোচনা করা মানে রাষ্ট্রপতির নিয়োগকে সমালোচনা করা।

তবে উপাচার্যরা বলেন, এটা সুখবর নয়। ৪৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষককেই কি সরকার খুঁজে পায়নি যাকে ট্রেজারার পদে নিয়োগ দেবে? স্বচ্ছতার প্রসঙ্গে তারা বলেন, শিক্ষকদের চেয়ে আমলারা বেশি স্বচ্ছ এটা প্রমাণ করুক। আসলে সবকিছু আমলাদের দখলে নিতে হবে- এ ধারণা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকি পদগুলো দখলে নেওয়ার পথে একধাপ এগিয়ে গেল তারা।  

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার পদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নিয়োগ দেওয়া হয় দেখে আসছি। হঠাৎ সরকার হয়তো কোনো সংগত কারণে সরকারি কর্মকর্তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্বে অন্য পেশাজীবী আসুক সেটা শিক্ষকরা চান না। এ দায়িত্ববোধটুকু তাদের জাগ্রত হতে হবে। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

অবসরপ্রাপ্ত (পিআরএল) একজন অতিরিক্ত সচিবকে ট্রেজারার পদে নিয়োগ দেওয়ায় এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। 

শুক্রবার (৭ মে) সংগঠনটির সভাপতি অধ্যাপক ড. নূরে আলম আব্দুল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. শামীম বেগম স্বাক্ষরিত এক প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয়, একজন কোষাধ্যক্ষ ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে সমন্বয় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সহ জ্ঞান-বিতরণ ও জ্ঞান সৃষ্টির নানা কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করেন। কাজেই একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদই এই পদের যোগ্য। এই পদে একজন সরকারি কর্মকর্তার নিয়োগদান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আমলাতন্ত্রের নগ্ন হস্তক্ষেপ।

বিষয়টির সমালোচনা করে ইমরান হোসেন নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বেশি বেশি বিল্ডিং বানানো মানেই উন্নয়ন নয়। তেমনি জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় বানানোও শিক্ষার উন্নয়ন নয়। বরং এটা হতে পারে উচ্চবিলাসী আমলাদের চাল। যাদের শেষ বয়সের উচ্চ আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি ঘটবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা হওয়ার মাধ্যমে। এটা আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। কিন্তু শিক্ষকেরা মানলেন না। কোনো কোনো মেরুদণ্ডহীন শিক্ষক মনে করলেন এটা সরকার বিরোধিতা। কোনো কোনো পদলোভী শিক্ষক মনে করলেন এই তো সুযোগ ভিসি হওয়ার। বেশি বেশি বিশ্ববিদ্যালয় মানে বেশি বেশি ভিসি। কিন্তু এর মাধ্যমে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগেকার ‘ডিগ্রি কলেজে’ রূপান্তর হয়ে যায় সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না।’

অতিরিক্ত সচিবকে ট্রেজারার পদে নিয়োগের প্রজ্ঞাপনটি ফেসবুকে পোস্ট করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. সামিউল ইসলাম লিখেছেন, ‘সব পেশায় অগ্রজদের ন্যূনতম ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থাকে যারা পেশার গুণগত মানের উৎকর্ষ সাধনে কাজ করে। আমাদের শিক্ষক নেতারা এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা পদপ্রাপ্তির জন্য বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিক্ষকদের চিন্তা-চেতনা সঠিকভাবে উপস্থাপন ও গুরুত্ব অনুধাবন করাতে ব্যর্থ হয়েছেন।’

এনএম/ওএফ/জেএস