করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার চেষ্টা করা হলেও এতে যুক্ত থাকতে পারেনি অনেক শিক্ষার্থী। গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পর্যায়ের ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। ইতোমধ্যে ৬ মাসের বেশি জটের মধ্যে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বর্ষের শিক্ষার্থী। এ অবস্থায় অনলাইনে পরীক্ষার কথা ভাবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

আগামী ১ জুলাই থেকে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু  অনলাইন ক্লাস এবং শিক্ষা কার্যক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বেশ কিছু বিভাগের জরিপে দেখা গেছে, অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত হতে পারছেন না ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী। শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, গণমাধ্যমে উঠে আসা বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, ডিভাইস না থাকা, ইন্টারনেটের নিম্ন গতিসহ বিভিন্ন কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে অনলাইন পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের শতভাগ অংশগ্রহণ সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। খোদ শিক্ষার্থীরাই বলছে, এ বিষয়গুলোর সমাধান না করে অনলাইন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তারা চিন্তিত।
 
অনলাইন পরীক্ষা দিতে শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জ
অনলাইনে পরীক্ষার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, যেভাবেই হউক পরীক্ষা দিতে চান। তবে অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষার ধরন, ইন্টারনেটের গতি, ডিভাইস না থাকা, মাঝপথে পরীক্ষা থেকে ছিটকে পড়া, ইন্টারনেটের উচ্চমূল্যসহ নানান প্রতিবন্ধকতা নিয়ে চিন্তিত। অনেকে শিক্ষার্থী অনলাইন পরীক্ষা নয় বরং অ্যাসাইনমেন্ট আকারে পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তাসনিম হাসান আবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে পরীক্ষা নেওয়া হয়নি, যার কারণে ইতোমধ্যেই শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ে গিয়েছে। করোনা সম্প্রতি যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে কবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হবে সে নিয়েও প্রশ্ন আছে। এমতাবস্থায় অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক। তবে ঢাবিতে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার মত ব্যবস্থা বা পরিস্থিতি আদৌ রয়েছে কিনা সেটা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। ইতোপূর্বে আমরা দুর্বল নেটওয়ার্ক, স্মার্ট ডিভাইস, প্রয়োজনীয় ডাটার অভাবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসেই যোগ দিতে পারিনি। এই সমস্যাগুলো দূর করে তবেই অনলাইন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে হবে, অন্যথায় আমরা বঞ্চিত হবো।

অ্যাসাইনমেন্ট আকারে পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানিয়ে দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী মিঞা বলেন, অনলাইন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হবে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য একটি অবিবেচক ও স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত। যেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের চাওয়াই প্রতিফলিত হচ্ছে না বলে আমি মনে করি। যেখানে অনলাইন ক্লাস করতে ঘরের বাইরে যেতে হয়েছে, গাছে ওঠার মতো ঘটনা ঘটেছে, ক্লাসের মধ্যে কয়েকবার ডিসকানেক্ট হয়েছে —এমন একটি দেশে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া নিছক বিলাসিতা। তাছাড়া হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ডিভাইসও নেই যে তারা পরীক্ষা অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে। তাই আমি মনে করি অনলাইন পরীক্ষার চেয়ে অ্যাসাইনমেন্ট
পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য অধিক সুবিধাজনক ও ফলপ্রসূ হবে, যেখানে শহর, গ্রাম, ধনী, গরীব সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।

বিভাগ ইনিস্টিটিউটের চ্যালেঞ্জ
অনলাইন পরীক্ষার প্রতিবন্ধকতা দেখছেন শিক্ষকরাও। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, অনলাইনে খাতা দেখাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কথা স্বীকার করলেও তারা বলছেন, এর কোনো বিকল্প নেই, সমস্যা সমাধান করে অনলাইন পরীক্ষায় যেতে হবে।

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনলাইনে পরীক্ষাটা নেওয়াও আমাদের চ্যালেঞ্জ। আমরা শুধুমাত্র ফাইনাল পরীক্ষাটা নিব। তাও সময় কমিয়ে দিয়ে তিন ঘণ্টার পরীক্ষা দেড় ঘণ্টায় নেব, ৫০ মার্কের পরীক্ষা ২৫ মার্কে নেব। ফ্যাকাল্টি ভিত্তিক মিটিং করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব পরীক্ষাটা কোন প্রক্রিয়ায় নেওয়া যায়।

ইংরেজি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. নেভিন ফরিদা বলেন, আমাদের প্রতিবন্ধকতা অনেক। অনলাইন প্রযুক্তির সক্ষমতা আমাদের খুবই কম। যে ল্যাবগুলো আছে, সেগুলোও ততটা কার্যকর নয়। প্রাইভেট ভার্সিটিতে দেখা যায় সবকিছু প্রস্তুত থাকে শিক্ষকরা শুধু লেকচার দেয়, আমাদের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো। আমাদের নিজেদেরই সব কিছু ঠিক করে নিতে হয়। তাছাড়া কলা অনুষদের এত বেশি প্রযুক্তি সক্ষমতা প্রয়োজন নেই ভাবা হয়, তাই আইসিটির ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। অনলাইনে খাতা দেখাও একটি সমস্যা। কোন পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কতটা সহযোগিতা করবে তার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। তবে এটা সত্য যে অনলাইন পরীক্ষার কোনো বিকল্প নেই। যদি ছাত্রদের উপকার আমরা করতে চাই, তাহলে সব সমস্যার সমাধান করে এ সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সহযোগী অধ্যাপক ড. ম. মনিনুর রশিদ বলেন, প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমাদের শিক্ষকরা প্রস্তুত না, এটা হুট করে হবে না। প্রস্তুত করতে হবে। আমাদের আইবিএ কিন্তু এই অনলাইন পরীক্ষা নিচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিগুলো অলরেডি এ কাজ করেছে। তারা শুধুমাত্র ১৫ দিনের একটা ট্রেনিং নিয়ে অনলাইনে চলে গেছে। তাদের আইটি সেকশনটা রেডি ছিল, যাতে অনলাইন পরীক্ষা নিতে হবে। আমাদেরও আইটি ডিপার্টমেন্ট আছে, সেটার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যেকোন কিছু শুরু করলে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকবে, একটা সময় পারফেক্ট হয়ে যাবে। আমরা অনেক অনলাইন পরীক্ষা নিচ্ছি, দিচ্ছি এটা কঠিন কিছু না।

তিনি আরও বলেন, নতুন যেকোন কাজেই চ্যালেঞ্জ, করোনাও আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ থাকবে, এটা আমাদের এক ধরনের উদ্ভাবনের শক্তি দেবে। অনলাইন পরীক্ষাটাও আমাদের চ্যালেঞ্জ, এ চ্যালেঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উৎরাতে হবে। এই অনলাইন পরীক্ষার বিষয়টা আরও এক বছর আগেই ভাবা উচিত ছিল। আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে অলরেডি একটি বছর নষ্ট হয়ে গেছে, শিক্ষার্থীরা জব মার্কেটে ঢুকতে পারছে না, এ সিদ্ধান্তটা নেওয়া এবং কার্যকর করা উচিত।

কী বলছেন শিক্ষাবিদরা
দেশের শিক্ষাবিদরাও অনলাইন পরীক্ষার সপক্ষে মত দিচ্ছেন না। তারা বলছেন, এতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বৈষম্যের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি অনলাইন পরীক্ষা নিতেই হয় তাহলে সবার জন্য সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে হয়ত অনলাইন পরীক্ষার বিকল্প থাকবে না। সেক্ষেত্রে অনলাইন পরীক্ষা নিতে হলে অনলাইন সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি যারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পরীক্ষা দেবে, তাদের সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি, ডিভাইস এবং ইন্টারনেট কানেকশন নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবে কোনো শিক্ষার্থী যেন বঞ্চনার শিকার না হয় সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের দেখা উচিত।

সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করে অনলাইন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ঢাবির সাবেক এই ভিসি বলেন, অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেক শিক্ষার্থী যুক্ত হতে পারেনি। অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রেও তেমনটি যেন না ঘটে। পরীক্ষায় যাতে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, উত্তম হচ্ছে সরাসরি পরীক্ষা নেওয়া। করোনা সংক্রমণ থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় খোলাও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে, যেহেতু আবাসিক হলগুলোও খুলতে হবে। তবে অনলাইন ক্লাসকে কোনোভাবে আদর্শ ব্যবস্থা বলা যাবে না। অনেক শিক্ষার্থী এতে বঞ্চিত পারে, এটি যথাযথ ব্যবস্থা নয়, এর বিকল্প কী সেটা ভাবতে হবে। 

ইউজিসির সিদ্ধান্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাগুলো এখন থেকে অনলাইনে নেওয়া যাবে বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তবে এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য একটি গাইডলাইন এবং বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছে এ সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটি। এগুলো মেনে পরীক্ষা নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।

তবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষার্থী যদি অনলাইনে পরীক্ষা দিতে না চায় সেক্ষেত্রে তাদের চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কোন ইউনিভার্সিটি যদি মনে করে অনলাইনে পরীক্ষা না নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অফলাইন পরীক্ষা নেবে; সেটিও করতে পারে তারা। অর্থাৎ কাউকে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত
গত ৬ মে  ঢাকা শিক্ষা পরিষদের (একাডেমিক কাউন্সিল) সভায় পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ১ জুলাই থেকে অনলাইনে পরীক্ষার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সভায়, কৌশলগত কারণে প্রতিটি কোর্সকে একাধিক ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন ধরন/পদ্ধতিতে পরীক্ষা (যেমন: বর্ণনামূলক সংক্ষিপ্ত আকারে, এমসিকিউ, কুইজ, অ্যাসাইনমেন্ট এবং ওপেনবুক পরীক্ষা) নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরীক্ষার সময় ও পূর্ণমান কমানো হবে, তবে মূল্যায়নকরা ফলাফলকে প্রচলিত পূর্ণমানে রূপান্তর করে চূড়ান্ত ফলাফল তৈরি করা হবে। ক্রেডিট অপরিবর্তিত থাকবে বলা হয়। এছাড়াও বলা হয়, কম্পিউটারভিত্তিক ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলো অনলাইনে নেওয়া হবে। অন্যান্য ল্যাব-ভিত্তিক ব্যবহারিক পরীক্ষা যথাযথ নিয়মে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নেওয়া হবে।

সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনুষদের ডিনরা ও ইনস্টিটিউটের পরিচালকরা অনলাইনে পরীক্ষাগ্রহণের জন্য নিজ নিজ একাডেমিক ঘরানার পরীক্ষা ও প্রশ্নের ধরন নির্ধারণ করে একটি গাইডলাইন তৈরি করবেন। তারা আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে এ গাইডলাইন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের (শিক্ষা) কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।

এইচআর/এসএম