নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই, তারপরও রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের চাপে প্রতিনিয়ত অনুমোদন পাচ্ছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রতি বছর এমপিওভুক্ত হওয়ায় চাপ বাড়ছে। এমন অনিয়মের লাগাম টানতে এবার কঠোর হতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের স্বীকৃতি, পাঠদান ও একাডেমিক স্বীকৃতির নীতিমালায় কঠোরতা আনতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়েছে। ফলে বদলে যাচ্ছে প্রায় ২২ বছর আগে করা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও স্বীকৃতির নীতিমালা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চাহিদা যাচাই না করে অপ্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমতি দেওয়ায় শিক্ষা খাতে বরাদ্দের বিশাল অঙ্ক ব্যয় হচ্ছে এমপিও খাতে। কারণ নতুন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়েই চাপ দেওয়া হয় এমপিও করতে। এমন চাপ কমাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন, চালুকরণ ও স্বীকৃতি প্রদানে কঠোর নীতিমালা করতে আট সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোমিনুল রশিদ আমিনকে (মাধ্যমিক- ২) কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। সদস্য করা হয়েছে- উপসচিব (কলেজ- ৬), উপসচিব বেসরকারি মাধ্যমিক- ১), পরিচালক (ব্যানবেইস), মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (কলেজ), মাউশি পরিচালক (মাধ্যমিক), ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক। কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শককে।

কমিটি বর্তমান নীতিমালা পর্যালোচনা, পরিমার্জন ও সংশোধন করে ‘বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের প্রশাসনিক আওতাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও কলেজ) স্থাপন, চালুকরণ ও স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় নীতিমালা (সংশোধন) ২০২১’ এর খসড়া দাখিল করবে। কমিটি প্রয়োজনে অন্যান্য সদস্য ‘কো-অপ্ট’ করতে পারবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হচ্ছে। যারা মধ্যে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয় সরকার। দেশের শিক্ষার মানচিত্র অনুযায়ী প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল-কলেজ) সংখ্যা অনেক বেশি। প্রয়োজন না থাকলেও প্রভাবশালীদের তদবিরে ও রাজনৈতিক বিবেচনায় গড়ে উঠেছে এসব স্কুল-কলেজ।

এ ব্যাপারে  নীতিমালা তৈরি কমিটির আহ্বায়ক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক- ২) মোমিনুল রশিদ আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বর্তমান যে নীতিমালাটি আছে সেটি ১৯৯৭ সালের। ফলে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। এতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিমালাটি যুগোপযোগী করার প্রয়োজন মনে করেছে। 

নীতিমালাটি যুগোপযোগী করার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি শিগগিরই বৈঠকে বসবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে নীতিমালার খসড়া তৈরি করে জমা দেওয়া হবে।

মোমিনুল রশিদ আমিন, কমিটির আহ্বায়ক

তিনি আরও বলেন, এমপিও দেওয়ার সঙ্গে যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থাপন, চালুকরণ ও স্বীকৃতির বিষয়টি সরাসরি জড়িত, তাই এটা সংশোধন ও যুগোপযোগী করা জরুরি। এমপিও নীতিমালা জারির আগেই এই নীতিমালার কাজ শেষ করতে চাই।
 
বিদ্যমান নীতিমালায় যা আছে

১৯৯৭ সালের বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও স্বীকৃতি নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার জন্য একটি নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা যাবে। শহরের ক্ষেত্রে একটি স্কুল থেকে আরেক স্কুলের দূরত্ব এক কিলোমিটার এবং মফস্বলে তিন কিলোমিটার হতে হবে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে যথাক্রমে এক কিলোমিটার ও চার কিলোমিটার হতে হবে।

উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ স্থাপনের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা কমপক্ষে ৭৫ হাজার হতে হবে। দূরত্বের ক্ষেত্রে শহরে দুই কিলোমিটার এবং মফস্বলের ক্ষেত্রে ছয় কিলোমিটার হতে হবে।

সূত্র জানিয়েছে, নতুন নীতিমালায় জমির পরিমাণও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।

যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, মান নিয়ে প্রশ্ন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো নীতিমালা অনুযায়ী প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সারাদেশে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তারই একটি পঞ্চগড়ের দেবিগঞ্জ উপজেলার হাজিরহাট নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির রাস্তার অপর পাশে অনেক আগে স্থাপিত হয়েছে শেখ রাসেল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

দুই বছর আগে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি হাজিরহাট নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির অনুমতির জন্য চাপ দেন। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটিকে পাঠদানের অনুমতি দেয়নি। পরবর্তীতে ওই জনপ্রতিনিধি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসলে ফের চাপ দিয়ে স্কুলটির অনুমোদন করিয়ে নেন। স্থানীয়রা জানান, হাজিরহাট স্কুলের অনুমোদনের কারণে উভয় প্রতিষ্ঠানই শিক্ষার্থী সংকটে পড়বে।

অপরদিকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানচিত্র’ অনুযায়ী রাজশাহী বিভাগে নতুন কোনো কলেজের প্রয়োজন না থাকলেও গত দুই বছরে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপির চাপে অনুমোদন দিতে বাধ্য হয়েছে মন্ত্রণালয়— এমনটি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

তারা আরও জানান, বিগত দিনে স্কুল-কলেজের অনুমতির চিঠি মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে দেওয়া হলেও সম্প্রতি তা দেওয়া হচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অগোচরে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী অর্থের বিনিময়ে গোপনে অনুমোদন করিয়ে দিচ্ছেন। কৌশলগত কারণে তা ওয়েব সাইটে দেওয়া হচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং শিক্ষাবোর্ডের কয়েকজন চেয়ারম্যান ঢাকা পোস্টের কাছে ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ খাটিয়ে অনুমোদন নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তারা বলেন, বিগত দিনে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া স্কুল-কলেজের বেশির ভাগই মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে পারছে না। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল ও ভর্তির তথ্যে সে চিত্র স্পষ্ট।

অনলাইনে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বের হয়ে আসছে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া কলেজগুলোর বাস্তব চিত্র। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ না থাকায় শিক্ষার্থীরাও ভর্তি হতে চাইছেন না। কলেজগুলো তাই শিক্ষার্থী সংকটে ধুঁকছে। একাদশ শ্রেণিতে প্রতি বছরই লাখ লাখ আসন খালি থাকছে।

এনএম/এমএআর