সেশনজট, ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা, সনদ বিতরণে জটিলতা আর পরীক্ষকদের খাতা মূল্যায়নের বিল বকেয়াসহ দীর্ঘদিন ধরে নানা সংকট ও অব্যবস্থাপনায় নিমজ্জিত ছিল ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে, সাম্প্রতিক সময়ের ধারাবাহিক উদ্যোগ, কঠোর তদারকি ও সংস্কারের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি ধীরে ধীরে সেই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন এক পরিবর্তনের পথে হাঁটছে।

সবচেয়ে বড় সুখবর হলো, বিশ্ববিদ্যালয়টির দীর্ঘ আট বছরের সনদ ও সেশনজট এখন প্রায় সমাধানের পথে। এজন্য নেওয়া হয়েছে বিশেষ ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’। ৬ লাখের বেশি শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে পাচ্ছেন সনদ ও নিয়মিত সেশন কাঠামোর স্বস্তি। চলতি বছরের বাকি চার মাসে নেওয়া হবে ৩টি বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা। ফল প্রকাশও করা হবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। এদিকে নতুন প্রজন্মের চাহিদা মেটাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হচ্ছে ইসলামী অর্থনীতি ও ইসলামী ব্যাংকিং-এর মতো নতুন বিভাগ। আগামী বছর (২০২৬) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন করার চিন্তাও করছে প্রশাসন।

নিজস্ব উদ্যোগে ফল প্রকাশ : খরচ কমেছে, গতি বেড়েছে

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল প্রকাশের পুরো প্রক্রিয়া নির্ভর করত তৃতীয় পক্ষের ওপর। বাইরের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফল প্রস্তুতি ও প্রকাশ করতে হতো, যা সময়সাপেক্ষ ছিল এবং এতে খরচও হতো অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, ফলাফলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দীর্ঘদিন ধরে সেই প্রতিষ্ঠানের আশায় বসে থাকতে হতো। ফলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি আরও বাড়ত।

তবে, এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব উদ্যোগে ফল প্রকাশের সক্ষমতা তৈরি করেছে। প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি অবকাঠামো গড়ে তুলে নিজস্ব পরীক্ষণ ও ফল প্রস্তুতি সেল চালু করা হয়েছে। এর ফলে খরচ কমছে, সময় বাঁচছে এবং ফলাফলের স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতাও নিশ্চিত হচ্ছে।

অন্যদিকে পরীক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে বিল ও ফল প্রকাশে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার উদ্যোগে। আগে খাতা মূল্যায়নের টাকা বছরের পর বছর ধরে বকেয়া থাকত, পরীক্ষকদের অসন্তোষও ছিল প্রবল। এখন আর সেই চিত্র নেই। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরে খোলা হয়েছে আলাদা বিল সেকশন। ফলে একজন পরীক্ষক খাতা জমা দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। এতে যেমন পরীক্ষকদের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে, তেমনি খাতা মূল্যায়ন প্রক্রিয়াও দ্রুততর হয়েছে।

এ ছাড়া, গড়ে তোলা হচ্ছে অত্যাধুনিক টিচারস ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম। এর মাধ্যমে কোন শিক্ষক কয়টি খাতা মূল্যায়ন করেছেন, তার কাজের মান কেমন ছিল— সব তথ্য ডিজিটালভাবে সংরক্ষিত থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এই সিস্টেম চালু হলে একদিকে অনিয়মের সুযোগ কমবে, অন্যদিকে যোগ্য শিক্ষকদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে প্রণোদনা দেওয়ার পথ তৈরি হবে। পরীক্ষার খাতায় মান বজায় রাখা যাবে আরও কার্যকরভাবে।

সনদ বিতরণে চলছে রাত-দিন কাজ

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গা ছিল সনদপ্রাপ্তি। ২০১৮ সালে যারা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছেন তাদের সনদ ২০২৪ সালেও বিতরণ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়। এতে করে চাকরির আবেদন, ইন্টারভিউ, এমনকি বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়তেন শিক্ষার্থীরা।

এই অচলাবস্থা কাটাতে এখন প্রতিদিন শত শত সনদে স্বাক্ষর করা হচ্ছে, কাজ চলছে সপ্তাহের সাত দিন, এমনকি সরকারি ছুটির দিনও কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাসুম বিল্লাহ জানান, এখন কয়েকটি বর্ষের পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের পরপরই শিক্ষার্থীদের সনদ সরাসরি মাদ্রাসায় পৌঁছে যাচ্ছে। আগে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন ধরে সনদের জন্য অপেক্ষা করতে হতো, যা তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চাকরি বা উচ্চশিক্ষার সুযোগকে প্রভাবিত করত। বর্তমানে প্রথা পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে সনদ হাতে পাচ্ছেন।

এ বছরই সেশনজট ও সনদজটমুক্ত হবে বিশ্ববিদ্যালয় : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক

আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন, পরিকল্পিত উদ্যোগ ও কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এ বছরের মধ্যে দীর্ঘদিনের এই জট থেকে মুক্তি পাবেন। নতুন ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছ ফল প্রকাশ এবং দ্রুত সনদ বিতরণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি ধীরে ধীরে নিজস্ব কার্যক্রমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে, যা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নতুন আশার সঞ্চার করছে।

মোহাম্মদ আলী ঢাকা পোস্টকে জানান, গত আট বছরের সনদের জট তিনি ও তার টিম মাত্র ছয় মাসের মধ্যে সমাধানের পথে নিয়ে এসেছেন। চলতি বছরের মধ্যে সব সনদ বিতরণ সম্পন্ন করা হবে বলে আশা করছেন তিনি।

তিনি বলেন, গত বছর এখানে যোগ দেওয়ার পরই আমাকে যে চিত্রটি সবচেয়ে হতবাক করেছে তা হলো সনদ বিতরণের অচলাবস্থা। দেখলাম, ২০১৮ সালের পরীক্ষার্থীরাও তখনো মূল সনদ হাতে পাননি। এদিকে খাতা মূল্যায়নকারীদের বকেয়া বিলও বছরের পর বছর ধরে আটকে ছিল।

তিনি আরও বলেন, আমি এসে দেখি, ছাত্ররা সনদ পাচ্ছে না, শিক্ষকরা খাতা কাটার পারিশ্রমিক পাচ্ছে না— পুরোপুরি অগোছালো অবস্থা। তবে কর্তৃপক্ষ আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে, সহযোগিতা করেছে। তাই পরিকল্পনা করে একের পর এক পরীক্ষা নেওয়া শুরু করি।

সেশনজট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় হাতে নিয়েছে এক ধরনের ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, যে পরীক্ষা এক বছর পর হওয়ার কথা, সেটি আমি সাত মাসেই সম্পন্ন করেছি। পাশাপাশি ফল প্রকাশের জন্য অপেক্ষা না করে ক্লাস শুরু করার নির্দেশ দিয়েছি। এতে সময় বাঁচছে, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতাও বজায় থাকছে।

এরই মধ্যে অনার্স ও মাস্টার্স স্তরের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। অক্টোবরের মধ্যে ফাজিল, নভেম্বরে কামিল দুই বছর মেয়াদি ও ডিসেম্বরের মধ্যে অনার্স পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগেই তিনটি বড় পরীক্ষা ও ফলাফল সম্পন্ন হবে বলে জানান মোহাম্মদ আলী। তার আশা, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে আমরা পুরোপুরি সেশনজটমুক্ত হতে পারব। ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে যে কেউ বলবে— ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোনো জট নেই।

তিনি জানান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিসে আনা হয়েছে নানা সংস্কার। বিল নিষ্পত্তির জন্য আলাদা সেকশন খোলা হয়েছে। পরীক্ষকরা খাতা মূল্যায়নের টাকা সময়মতো পাচ্ছেন। অনিয়ম ঠেকাতে তৈরি করা হচ্ছে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষক ব্যবস্থাপনা তথ্য সিস্টেম। এর মাধ্যমে কোন শিক্ষক কয়টি খাতা মূল্যায়ন করেছেন, কীভাবে কাজ করেছেন— সবই রেকর্ড থাকবে। ফলে অনিয়মের সুযোগ থাকবে না। পরীক্ষকদের পারিশ্রমিকও স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাংক হিসাবে জমা হবে।

মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের হাতে দ্রুত সনদ পৌঁছে দেওয়া। এর জন্য আমি রাত জেগে সনদ স্বাক্ষর করি। উপাচার্য স্যারও দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। কারণ, সনদ ছাড়া শিক্ষার্থীরা চাকরি বা বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু সনদ বা পরীক্ষা নিয়েই থেমে থাকতে চাইছে না। যুগোপযোগী নতুন বিষয় চালুর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী ব্যাংকিং, ইসলামী আইনসহ কর্মমুখী বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, ‘আমরা শুধু আলেম নয়, দক্ষ জনবল তৈরি করতে চাই, যারা দেশের জন্য সম্পদ হবে, বোঝা হবে না।’

২০২৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন আয়োজনের পরিকল্পনাও চলছে। তবে তার আগে সব সনদ বিতরণ ও স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের কাজ সম্পন্ন করা হবে।

নিজের অঙ্গীকার প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি চাই, মাদ্রাসার ছাত্ররা শুধু ইমাম বা শিক্ষক না হয়ে বা এসব কাজে সীমাবদ্ধ না থেকে বিসিএসসহ দেশের সব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিক। তাদের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ আরও আলোকিত হবে।

কর্মমুখী শিক্ষার দিকে এগোচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় : উপাচার্য

গতানুগতিক ধারা ভেঙে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্মমুখী শিক্ষার দিকে এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক ও সময়োপযোগী বিষয়ের সমন্বয়ে নতুন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলছে বিশ্ববিদ্যালয়। মাদ্রাসা মানেই কর্মহীনতা— এ ধারণা ভ্রান্ত। কোরআন-সুন্নাহ অধ্যয়ন করেও শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। আমরা চাই তারা আধুনিক সমাজে খাপ খাইয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে যাক।

ভিসি জানান, ইসলামী অর্থনীতি, ব্যাংকিং, ফাইন্যান্স, বিজনেস ও মার্কেটিংয়ের মতো বিষয়ে কোর্স চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা দ্বীনি ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে সাজানো হবে।

প্রথম সিনেট গঠনের প্রস্তুতি ও দীর্ঘদিনের সনদ জট নিরসনের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত এক বছরে আমরা প্রায় এক লাখ সনদ প্রস্তুত করেছি। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আশা করি, শিক্ষার্থীদের সব সংকট নিরসন হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি নতুন পরিবর্তনের যুগে পথচলা শুরু করবে।

আরএইচটি/এমজে