ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য
শিক্ষকের মর্যাদা বাড়াতে হবে, নয়ত জাতির অগ্রগতি থেমে যাবে
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষককে ‘জাতি গঠনের কারিগর’ বলা হলেও দেশের বাস্তব চিত্র ভিন্ন। একজন শিক্ষক সকালবেলা ক্লাসে ঢুকে পাঠদান শুরু করেন কিন্তু মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় সংসারের খরচের হিসাব। দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দুশ্চিন্তা যেন তার পাঠদানের অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে ছাত্রদের সামনে দাঁড়ালেও মনোযোগ ছিটকে যায় সংসারের চাপে।
ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম মনে করেন, অনেক শিক্ষক এখনো সংসারের দুশ্চিন্তা নিয়ে ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে থাকেন, যার ফলে শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগ সম্পূর্ণ দিতে পারেন না।
বিজ্ঞাপন
তিনি সতর্ক করে বলেন, মর্যাদা ও সুবিধা নিশ্চিত না করলে যোগ্য মানুষ শিক্ষকতায় আসবেন না। আর তা হলে জাতির অগ্রগতি থমকে যাবে।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে বিশেষ আলাপচারিতায় অংশ নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম ‘শিক্ষক’ শব্দের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, আমি একজন শিক্ষক হওয়ায় গর্বিত। কারণ মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, আমাকে শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়েছে। সুতরাং শিক্ষক শব্দের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা তিনিই। প্রকৃত শিক্ষক সেই, যার কাছ থেকে সারাজীবন শিখতে পারা যায়।
বিজ্ঞাপন
এই শিক্ষক যোগ করেন, বর্তমান সময়ে অনেক শিক্ষকতা কেবল মাস শেষে বেতন পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যদি শিক্ষকরা সত্যিকারের শিক্ষক হতেন, বাংলাদেশ অনেক আগেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত।
ড. শামছুল আলম বলেন, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলেও তা বাস্তবে কার্যকর হয় শিক্ষকের মাধ্যমে। একজন শিক্ষক যদি নিজেকে আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলেন, তবে শিক্ষার্থীরা শুধু জ্ঞান নয়, চরিত্রেও সমৃদ্ধ হবে। একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কেবল জ্ঞান দেন না, সুন্দর ও চমৎকার চরিত্রের অধিকারী করে গড়ে তোলেন।
তিনি বলেন, শিক্ষকদের উচিত ছাত্রছাত্রীদের আপন করে নেওয়া, ভালোবাসা-মমতা দিয়ে দক্ষ ও নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এটাই প্রকৃত শিক্ষকতার দায়িত্ব।
শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রভাবের গুরুত্ব নিয়ে নিজের শিক্ষাজীবনের স্মৃতি বর্ণনা করেন উপাচার্য। ড. শামছুল আলম বলেন, শিক্ষকের প্রভাবই আমাকে আজকের অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। শিক্ষক মানে শুধু পাঠদানকারী নন, তিনি আমার গুরুজন– যার কাছ থেকে আমি শিখেছি, তিনিই আমার শিক্ষক। বিশেষ করে আমি স্মরণ করি আমার প্রাক্তন অনেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে, যারা ক্লাসরুমের বাইরেও বসে জটিল ধারণাগুলো বোঝাতেন, কখনো বই পড়ার পদ্ধতি শেখাতেন, কখনো জীবনের মূলনীতি নিয়ে আলাপ করতেন। সেই শিক্ষকদের উৎসাহ এবং ধৈর্যই আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। আজও আমি মনে করি, সেই শিক্ষকদের প্রেরণা এবং উদ্দীপনা ব্যক্তিত্ব গঠনে, অধ্যয়নে এবং নেতৃত্ব প্রদানে অমূল্য ভূমিকা রেখেছে। এই স্মৃতি শিক্ষার শক্তি ও শিক্ষকের অবদানকে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরার অনুপ্রেরণা হিসেবেও কাজ করছে।
দেশের শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, আমাদের দেশে শিক্ষকের মর্যাদা নেই বললেই চলে। বাস্তব সুযোগ-সুবিধাও খুব সীমিত। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। শিক্ষকরা পেটে-ভাতে জীবন চালান, এজন্য জাতির অগ্রগতি থেমে যাচ্ছে। এই অবস্থার কারণে মেধাবী তরুণরা শিক্ষকতা পেশা বেছে নিতে আগ্রহী হয় না।
আরও পড়ুন
যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও ধরে রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুবিধা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে। যদি শিক্ষক ক্লাসে দাঁড়িয়েও সংসারের চাল নিয়ে চিন্তিত থাকেন, তাহলে শিক্ষার্থীর জন্য পুরো মনোযোগ দিতে পারবেন না। সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে আরও অনেক যোগ্য মানুষ শিক্ষকতায় আসবে।
বেসরকারি মাদ্রাসা ও ইসলামি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জীবনমানের প্রয়োজনীয় উন্নয়নের ওপরও গুরুত্ব দেন ড. শামছুল আলম। তিনি বলেন, শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জন নয়; এটি শরীর, মন ও আত্মার সুষম বিকাশের নাম। ইসলামী শিক্ষাই সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ধরে রাখে। তাই রাষ্ট্রকে শিক্ষকের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
দেশের সব শিক্ষকের উদ্দেশে উপাচার্য বলেন, শিক্ষকদের বড় বাড়ি বা গাড়ি নেই, তবুও শিক্ষার্থীর সম্মানই সবচেয়ে বড় সম্পদ। একবার এক ছাত্র নিজের সিট ছেড়ে আমাকে বসতে দিয়েছিল। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, এটাই শিক্ষকের সবচেয়ে বড় অর্জন। আমাদের উচিত আমাদের (শিক্ষকদের) মন, সময় ও চেষ্টা পুরোপুরি শিক্ষার্থীর জন্য উজাড় করা। রাষ্ট্র থেকে হয়ত সুবিধা সীমিত কিন্তু আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আল্লাহর বরকত ও জাতির সম্মান দুটোই পাওয়া সম্ভব।
শিক্ষকের আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, চলুন আমরা জাতির সন্তানদের জন্য নিজেদের সম্পূর্ণ উজাড় করি, তাদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশে অংশ নিই। যদি আমরা আন্তরিকভাবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলি, তবে জাতি ও দেশ উভয়ই সমৃদ্ধ হবে– এটাই শিক্ষকের প্রকৃত জয়।
আরএইচটি/এসএসএইচ