ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়েছে গ্রিন ইউনিভার্সিটির চতুর্থ সমাবর্তন

চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে গ্রিন ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েটদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ডিগ্রি নেওয়ার পর শুধু চাকরির জন্য ঘুরবেন, এটা যেন না হয়। নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। অন্যের চাকরির উৎস হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’ 

শনিবার (১৯ জুন) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের চতুর্থ সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এসব কথা বলেন। সমাবর্তনে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর।

অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ। বক্তব্য রাখেন গ্রিন ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন, উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. গোলাম সামদানী ফকির, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. ফায়জুর রহমান। সমাবর্তনে মোট এক হাজার ৪৬৪ জনকে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এর মধ্যে ছয়জনকে চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল এবং ১৩ জনকে ভাইস চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল দেওয়া হয়। 

সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এবারের সমাবর্তন ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়। দেশের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে (জুম) সমাবর্তন আয়োজন করল গ্রিন ইউনিভার্সিটি।‌

সভাপতির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের স্কলার হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বিদ্যালয়গুলোকে আরও সফট স্কিল, ইমোশনাল স্কিলের সঙ্গে মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। সেগুলো যদি আমরা শিক্ষার্থীদের দিতে না পারি, উচ্চশিক্ষার যে উদ্দেশ্য তা সফল হবে না। কাজেই আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রতি অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে। 

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষা প্রসারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সমানতালে ভালো করছে। তাদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। অনেকগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত উচ্চশিক্ষা প্রদানে যথেষ্ট ভালো ভূমিকা রাখছে। আমি আশা করি, আগামী দিনে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে স্থান করে নেবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা আমাদের নতুনভাবে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। গ্রিন ইউনিভার্সিটি এ অগ্রযাত্রার বড় অংশীদার। করোনা মহামারির মধ্যেও গ্রিন ইউনিভার্সিটি নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা মেনে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার চাকা গতিশীল রেখেছেন। তাদের এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি। 

শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে গুরুত্ব দিতে হবে গবেষণা ও নতুন জ্ঞান আহরণে। সেজন্য উন্নত মানের গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার- এসব তৈরি করতে হবে।

দীপু মনি বলেন, করোনা মহামারি সংকটের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে। অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম হয়তো আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের শুরু করতে হতো। কিন্তু করোনা আমাদের সেই দুয়ার আগেই খুলে দিয়েছে। অনলাইন লার্নিং, অনলাইন এডুকেশন আমরা শুরু করেছি এবং এখানে আমরা এখন দক্ষ হয়ে উঠেছি।

শিক্ষামন্ত্রী তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বিষয় শেয়ার করে গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আপনাদের উপদেশ দেব না। তবে কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। জীবন থেকে, আশপাশের পরিবেশ থেকে, কাছের মানুষ থেকে সব সময় শিখতে হবে। এ শিক্ষা কখনও আনন্দের হবে, কখনও দুঃখের হবে, কখনও অস্বস্তির হবে, কখনও পরিশ্রমের হবে। পরিস্থিতি যাই হোক তা অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনে প্রয়োগের চেষ্টা করতে হবে। তবেই জীবনে সফলতা আসবে।’ 

দীপু মনি বলেন, জীবনের কোনো শিক্ষাই বিফলে যায় না, কোনো না কোনো সময় তা কাজে লাগে। জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি অভিজ্ঞতারও বিকল্প নেই। আমার এ জীবনে যা কিছু অর্জন, অর্জনের পেছনে যারা স্নেহ-ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের যেমন স্মরণ করি, ঠিক তেমনি আমারই অগ্রযাত্রা যারা থামিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাদেরও স্মরণ করি। যারা আমার অগ্রযাত্রার সামনে বাধার দেয়াল তৈরি করে পরাজিত করতে চেয়েছিলেন তাদের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। তাদের কারণে আমি শিখেছি, কীভাবে বাধার দেয়াল অতিক্রম করতে হয়। কী করে উঠে দাঁড়াতে হয়। 

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সব সময় ইতিবাচক ধারণার চর্চা করতে হবে। কতটা ভালো আছেন সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে আপনি কতজনকে ভালো রাখতে পেরেছেন সেটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। হতাশা, নিরাশা, হিংসা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে হবে। প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার জন্য এমন কিছু করা যাবে না যা আপনাকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলে। এসব বিষয় মানলে সাফল্য একদিন আসবেই। 

গ্রিন ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসের ফাইল ছবি

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আপনারা যে যেখানেই থাকেন না কেন সব সময় বাবা-মায়ের প্রতি যত্নশীল হবেন। আগামী দিনে আপনাদের পথ চলার আশীর্বাদ হয়ে থাকবে মা-বাবার দোয়া। 

শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, আপনারা ভবিষ্যতের কাণ্ডারি। তবে প্রত্যেক গ্রাজুয়েটকে মনে রাখতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ হলেও জীবনের পাঠশালা প্রতিনিয়ত শেখাবে। আপনাদের নতুন চিন্তাধারাই সমাজ ও দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে সরকারের ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনার কথা তুলে ধরেন।

সমাবর্তন বক্তা অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সমাবর্তনের মাধ্যমে শুধু গ্রাজুয়েশন পর্বের সমাপ্তি ঘটছে না, বরং আজ থেকে জীবনের আরও একটি পর্বের সূচনা হচ্ছে। তা হলো ব্যবহারিক জীবন। নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়া এবং নিজের অবস্থান তৈরি করার জীবন। গ্রিন ইউনিভার্সিটির প্রত্যেক গ্রাজুয়েটকে সেই চ্যালেঞ্জে মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।’ 

বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি, স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের অগ্রগতি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার চিত্র তুলে ধরেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতেও এ ধারাবাহিকতা বজায় রেখে গ্রিন ইউনিভার্সিটিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। 

উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. গোলাম সামদানী ফকির বলেন, সমাবর্তনের মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থী বৃহত্তর কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতাও বাড়ে এ সমাবর্তন থেকে। সুতরাং গ্রিন ইউনিভার্সিটির প্রত্যেক গ্রাজুয়েটকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে। 

উপাচার্য বলেন, সাময়িক সনদ অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের কাজে আসে না। এ কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদের জন্য সমাবর্তন অবশ্যম্ভাবী বিষয়। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ভার্চুয়ালি আয়োজিত এ সমাবর্তন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কেও পথ দেখাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। 

উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গ্রিন ইউনিভার্সিটি এমন এক সময়ে সমাবর্তন আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি দিচ্ছে, যখন বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পণ করেছি। শুধু তা-ই নয়, একই বছরে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উৎসব করছি। 

অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. ফয়জুর রহমান। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট সদস্য, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আমন্ত্রিত অতিথি, অভিভাবক ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, গ্রিন ইউনিভার্সিটির যাত্রা শুরু ২০০৩ সালে। ২০১১ সালে ইউএস-বাংলা গ্রুপ দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন ছন্দে ফেরে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ১৮ বছর আগে স্বল্প পরিসরে যে প্রতিষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল, কালক্রমে তা এখন দেশের অন্যতম শীর্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।

এনএম/এইচকে