‘শ্রুতিলেখক’ কে হতে পারবেন, স্পষ্ট করে নীতিমালা জারি
পাবলিক ও শ্রেণি পরীক্ষায় প্রতিবন্ধী ও শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আরও সহজ ও ন্যায্য করতে নতুন নীতিমালা জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে শ্রুতিলেখক ও শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থীর সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়েছে এবং পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন এই নীতিমালার আওতায় এখন থেকে সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত সব পাবলিক ও শ্রেণি পরীক্ষায় অভিন্ন নিয়মে শ্রুতিলেখক সুবিধা প্রদান করা হবে।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, নীতিমালাটির নাম রাখা হয়েছে ‘পাবলিক ও শ্রেণি পরীক্ষায় শ্রুতিলেখক-এর সেবা গ্রহণ সংক্রান্ত নীতিমালা-২০২৫’। এতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, স্থায়ী প্রতিবন্ধিতা অথবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে যারা নিজ হাতে লিখতে অক্ষম, এমন পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
নীতিমালার শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শব্দের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘শ্রুতিলেখক’ বলতে সেই ব্যক্তিকে বোঝানো হবে, যিনি লিখতে অক্ষম পরীক্ষার্থীর মুখে বলা উত্তর শুনে তা যথাযথভাবে উত্তরপত্রে লিখে দেবেন। ‘শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থী’ বলতে এমন পরীক্ষার্থীকে বোঝানো হয়েছে, যিনি নিজ হাতে লিখতে না পারলেও মৌখিকভাবে উত্তর দিতে সক্ষম এবং শ্রুতিলেখকের সহায়তায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন।
বিজ্ঞাপন
শ্রুতিলেখককে হতে হবে দ্রুত লেখায় পারদর্শী
নীতিমালায় শ্রুতিলেখকের যোগ্যতা ও দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শ্রুতিলেখক নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ও প্রমিত উচ্চারণ, সহজে বোধগম্য হস্তাক্ষর, শুদ্ধ বানান এবং দ্রুত লেখায় পারদর্শী ব্যক্তিকে যাচাই করে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এছাড়া পরীক্ষাকালীন সময়ে শ্রুতিলেখকের দায়িত্বও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, শ্রুতিলেখক প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীকে সরবরাহ করা প্রশ্নপত্র নির্ভুলভাবে পড়ে শোনাবেন এবং পরীক্ষার্থীর প্রদত্ত উত্তর অবিকল বা হুবহু সঠিকভাবে উত্তরপত্রে লিখবেন। একইসঙ্গে উত্তরপত্রে পরীক্ষার্থী কর্তৃক পূরণীয় তথ্য- যেমন রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর অথবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নাম প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীর পক্ষে সঠিকভাবে পূরণ করার দায়িত্বও পালন করবেন।
এছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে চিত্রসম্বলিত প্রশ্ন যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে শ্রুতিলেখককে অবশ্যই পরীক্ষা কেন্দ্রের সব নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে।
শ্রুতিলেখকের যোগ্যতা যাচাই করবে পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ
নীতিমালা অনুযায়ী, শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থী নিজ উদ্যোগে শ্রুতিলেখক মনোনয়নের সুযোগ পাবেন। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শ্রুতিলেখক মনোনয়নে ব্যর্থ হলে পরীক্ষার্থীর লিখিত আবেদনের ভিত্তিতে পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ অথবা সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিব কিংবা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শ্রুতিলেখক সরবরাহ করবেন। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীর মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে নির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী যোগ্য ও দক্ষ শ্রুতিলেখক মনোনয়নের দায়িত্ব কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থীকে নির্ধারিত আবেদনপত্র অনুযায়ী অনলাইনে বা সরাসরি শ্রুতিলেখক নিয়োগের জন্য আবেদন করতে হবে। আবেদন গ্রহণের পর কর্তৃপক্ষ শ্রুতিলেখকের যোগ্যতা ও প্রদত্ত তথ্য যাচাই করবে। নির্ধারিত সর্বোচ্চ যোগ্যতার সীমা অতিক্রম করলে অথবা তথ্য অসত্য প্রমাণিত হলে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে আবেদন বাতিল করা যাবে।
এছাড়া অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য প্রদান বা অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল করার ক্ষমতাও রাখা হয়েছে। আবেদনকারীর সংখ্যার ভিত্তিতে প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রুতিলেখক হিসেবে সহায়তা দিতে স্বেচ্ছাসেবক মনোনয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন এবং এনজিওর সঙ্গে সমন্বয় করে শ্রুতিলেখক নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থীর আবেদনের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ যদি শ্রুতিলেখক মনোনয়ন করে, তাহলে পরীক্ষার অন্তত সাত দিন আগে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীর সঙ্গে শ্রুতিলেখকের সাক্ষাতের সুযোগ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে শ্রুতিলেখক সংক্রান্ত সব আনুষ্ঠানিকতা ও দাপ্তরিক কার্যক্রম পরীক্ষার কমপক্ষে সাত দিন আগে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে শ্রুতিলেখকের মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ এবং পরীক্ষার্থীর প্রাপ্য সুবিধাসংক্রান্ত বিষয়গুলো পরীক্ষার অন্তত সাত দিন আগে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রকে লিখিতভাবে জানাতে হবে। পাশাপাশি পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রধান, পরিদর্শক, নিরাপত্তারক্ষীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার কথা নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থীরা পাবেন এক-চতুর্থাংশ অতিরিক্ত সময়
নীতিমালায় শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থীদের জন্য শ্রুতিলেখকের সংখ্যা ও অতিরিক্ত সময়ের বিষয়টি স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থী নিজের মনোনীত সর্বোচ্চ দুইজন শ্রুতিলেখকের জন্য আবেদন করতে পারবেন। যাচাই-বাছাই শেষে পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ ওই দুইজনকে অনুমোদন দেবে। অনুমোদিত দুজনের মধ্যে যে কোনো একজনের সহায়তায় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন পরীক্ষার্থী।
এছাড়া পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে শ্রুতিলেখক সরবরাহ করা হলেও দুইজন শ্রুতিলেখকের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোনো কারণে একজন শ্রুতিলেখক অসুস্থ হয়ে পড়লে বা অনুপস্থিত থাকলে বিকল্প ব্যক্তি শ্রুতিলেখকের দায়িত্ব পালন করবেন- এমন ব্যবস্থার কথা নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে।
অতিরিক্ত সময় প্রদানের ক্ষেত্রেও নীতিমালা সুস্পষ্ট। এতে বলা হয়েছে, শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থীরা মোট পরীক্ষার সময়ের এক-চতুর্থাংশ অতিরিক্ত সময় পাবেন। অর্থাৎ প্রতি এক ঘণ্টার পরীক্ষার বিপরীতে অতিরিক্ত ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হবে। এক ঘণ্টার কম সময়ব্যাপী পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত সময় আনুপাতিক হারে নির্ধারণ করা হবে।
তবে পরীক্ষার সময়কাল যতই কম হোক না কেন, অতিরিক্ত সময় ন্যূনতম ১০ মিনিটের কম হবে না। শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থীর অতিরিক্ত সময় প্রাপ্তির বিষয়টি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রের কেন্দ্র-প্রধানকে অবহিত করতে হবে। একই সঙ্গে কেন্দ্র-প্রধানকে কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সব পরিদর্শককে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার কথাও নীতিমালায় বলা হয়েছে।
পরীক্ষায় ব্রেইল ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের অনুমতি
শ্রুতিনির্ভর ও প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক উপকরণ ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য ছাড় দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, যেসব পরীক্ষায় সাধারণভাবে ইলেকট্রনিক ডিভাইস, ক্যালকুলেটর, জ্যামিতি বক্স বা অনুরূপ সরঞ্জাম ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে, সেসব পরীক্ষায় শ্রুতিলেখক পরীক্ষার্থীর চাহিদা অনুযায়ী এসব উপকরণ ব্যবহার করতে পারবেন।
এছাড়া প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীরা তাদের উপযোগী সহায়ক সরঞ্জাম- যেমন টকিং ক্যালকুলেটর, ব্রেইল স্লেট, টেইলর ফ্রেম, জিওমেট্রি ম্যাট, হুইলচেয়ার, ব্রেইল স্কেল, অ্যাবাকাস, এনালগ ম্যাগনিফায়ার এবং পরীক্ষার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইলেকট্রনিক ম্যাগনিফায়ার ব্যবহার করতে পারবেন। এসব সরঞ্জাম ব্যবহারে কোনো বাধা দেওয়া যাবে না বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন পরীক্ষার্থী যদি ইলেকট্রনিক ম্যাগনিফায়ারের মতো কোনো সহায়ক ডিভাইস ব্যবহার করতে চান, তাহলে তা লিখিতভাবে পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডিভাইসটি সব পরীক্ষা কেন্দ্রে ব্যবহারযোগ্য- এমন বৈধ কাগজপত্র, নথি বা প্রত্যয়নপত্র দাখিল করতে হবে। যাচাই-বাছাই শেষে কর্তৃপক্ষ অনুমতি প্রদান করবে এবং বিষয়টি সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রকে অবহিত করবে।
বিশেষ ক্ষেত্রে শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থী পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে কম্পিউটার ব্যবহার করে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। এ সময় পরীক্ষার্থী তার উপযোগী কিবোর্ড ও হেডফোন ব্যবহার করতে পারবেন। পরীক্ষাকেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত কম্পিউটার ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই কম্পিউটারে ইন্টারনেট সংযোগ রাখা যাবে না। প্রয়োজনে পরীক্ষার অন্তত একদিন আগে কম্পিউটার ব্যবহারের প্রস্তুতির সুযোগ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
অন্যদিকে, শ্রুতিনির্ভর, অসুস্থ বা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে প্রতিষ্ঠান প্রধান, কেন্দ্র সচিব বা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে। এর মধ্যে পরীক্ষার্থীর জন্য নীচতলায় পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি পরীক্ষার্থীর প্রতিবন্ধিতা বা দুর্ঘটনার ধরন অনুযায়ী উপযোগী আসন, প্রয়োজনীয় টেবিল-চেয়ার বা বেডের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থী বা তার অভিভাবক প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহে কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করতে পারবেন।
প্রতারণা-জালিয়াতি প্রমাণিত হলে বাতিল হবে পরীক্ষা
শ্রুতিনির্ভর ও প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নীতিমালায় প্রমাণক যাচাই, শ্রুতিলেখকের সম্মানী, অভিযোগ প্রতিকার এবং প্রতারণা প্রতিরোধ সংক্রান্ত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর ৩১ ধারার আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ইস্যু করা পরিচয়পত্র বা ‘সুবর্ণ নাগরিক কার্ড’ই প্রতিবন্ধিতার বৈধ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন পরীক্ষার্থী অথবা আকস্মিক দুর্ঘটনাজনিত কিংবা স্থায়ী প্রতিবন্ধিতার কারণে নিজ হাতে লিখতে অক্ষম কোনো পরীক্ষার্থী শ্রুতিলেখকের সহায়তায় পরীক্ষায় অংশ নিতে চাইলে তাকে সিভিল সার্জন বা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করতে হবে। ওই প্রত্যয়নপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে যে পরীক্ষার্থী দুর্ঘটনাজনিত বা স্থায়ী প্রতিবন্ধিতার কারণে নিজে লিখতে অক্ষম। এ বিষয়ে পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে নিয়োগকারী বা পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ। তবে প্রত্যয়নপত্রের মেয়াদ সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে হতে হবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে।
নীতিমালায় শ্রুতিলেখকদের সম্মানী বা পারিতোষিক প্রদানের বিষয়টিও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রুতিলেখকদের সম্মানী প্রদান বাধ্যতামূলক হবে। সম্মানীর পরিমাণ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে এবং পরীক্ষার জন্য প্রণীত বাজেটে এ খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি পরীক্ষার কার্যক্রম শেষে শ্রুতিলেখকদের উৎসাহিত করতে সনদপত্র বা প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার ব্যবস্থাও রাখতে বলা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে আরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক এ ধরনের সহায়তামূলক কার্যক্রমে আগ্রহী হন।
অভিযোগের প্রতিকার ও প্রতারণা প্রতিরোধে কড়া নির্দেশনা
নীতিমালায় অভিযোগের প্রতিকার করা এবং প্রতারণা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কড়া বিধান রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, শ্রুতিলেখক মনোনয়নের ক্ষেত্রে কোনো অসঙ্গতি দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট পক্ষ সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগ জানাতে পারবেন। অভিযোগ পাওয়ার পর সাত কর্মদিবসের মধ্যে নীতিমালা অনুসরণ করে তা নিষ্পত্তি করা হবে।
একই সঙ্গে পরীক্ষা কেন্দ্রের পরিদর্শকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, শ্রুতিনির্ভর পরীক্ষার্থী যেন কোনোভাবে বিশেষ সহায়ক ডিভাইস বা শ্রুতিলেখকের মাধ্যমে নিয়মবহির্ভূত, অনৈতিক বা অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করতে না পারেন।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, শ্রুতিলেখক মনোনয়ন বা শ্রুতিলেখকের মাধ্যমে পরীক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতারণার প্রমাণ মিললে অভিযুক্ত পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল করা হবে এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া শ্রুতিলেখকের সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতাও নির্ধারণ করা হয়েছে। নীতিমালায় বলা হয়েছে- প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক শ্রুতিলেখক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী, সপ্তম শ্রেণির জন্য ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী, অষ্টম শ্রেণির জন্য সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী, নবম শ্রেণির জন্য অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী, এসএসসির জন্য অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং এইচএসসির জন্য দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শ্রুতিলেখক হিসেবে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন।
স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের জন্য এইচএসসি শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষের জন্য প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষের জন্য দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষের জন্য তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ও এর উপরের পরীক্ষা যেমন বিসিএসের জন্য স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা শ্রুতিলেখকের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
ন্যায্য পরীক্ষা নিশ্চিত করতে শ্রুতিলেখক ব্যবহারে নতুন নীতিমালা প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী উদ্যোগ বলে মনে করছেন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, বরিশালের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ইউনুস আলী সিদ্দিকী।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, সব পাবলিক পরীক্ষায় শ্রুতিলেখক ব্যবহারে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের ফলে দীর্ঘদিনের বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা দূর হয়েছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও আকস্মিক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত পরীক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত সময়, শ্রুতিলেখক এবং ব্রেইল স্লেট, টকিং ক্যালকুলেটর ও ম্যাগনিফায়ারের মতো সহায়ক যন্ত্র ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করা একটি মানবিক সিদ্ধান্ত। এতে শিক্ষার্থীরা সমান সুযোগে ন্যায্য ও স্বচ্ছ পরিবেশে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে এবং তাদের প্রকৃত মেধা ও যোগ্যতা প্রকাশের সুযোগ পাবে।
তিনি আরও বলেন, নীতিমালায় জালিয়াতি ও নকলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান রাখায় পরীক্ষার শৃঙ্খলা ও বিশ্বাসযোগ্যতা আরও ভালো হবে। সামগ্রিকভাবে এই উদ্যোগ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও শিক্ষার্থী-বান্ধব করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আরএইচটি/এমএসএ