একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা লুৎফর রহমান। দীর্ঘদিন পর রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে রূপনগর আবাসিক এলাকার মনিপুর স্কুলে মেয়েকে পৌঁছে দিতে এসেছেন। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিলেন।

লুৎফর রহমান ঢাকা পোস্টকে বললেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর স্কুল খোলায় আমার সন্তান এবং অভিভাবকরা খুবই খুশি। গতকাল থেকেই আমার মেয়ে বিভিন্নভাবে ভালো লাগার কথা জানিয়েছে। মেয়ের আনন্দে আমাদের মনেও স্বস্তি এসেছে। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন স্কুল-কলেজ খোলা রাখা হয়। এ বিষয়ে যেন নজরদারিটা বাড়ান হয়।  

এক প্রশ্নের জবাবে লুৎফর রহমান ঢাকা পোস্টকে আরও বলেন, আমার মেয়ে আজ স্কুলের ড্রেসের সঙ্গে জুতা পরে আসতে পারেনি। কারণ স্কুলের জুতাটা অনেক ছোট হয়ে গেছে। এজন্য অন্য কালারের জুতা পরে এসেছে। এছাড়া জামাটা অনেক টাইট হয়ে গেছে। মানে এখন নতুন করে ফুল ড্রেস সেট বানাতে হবে। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষকে একটু সময় দিতে হবে। কারণ সব টেইলার্সেই বর্তমানে ড্রেস বানানোর প্রচুর চাপ।

জয়নাল নামের আরেকজন অবিভাবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্কুল খোলায় আমাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। গত দেড় বছর বাচ্চারা লেখাপড়ার বাইরে ছিল। যদিও অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস হতো। তারপরও আমি বলবো, অনলাইনের ক্লাসের গুরুত্ব বাচ্চাদের বা আমাদের কাছে নেই। সশরীরে উপস্থিত থেকে শিক্ষা নেওয়া আর অনলাইনে ক্লাস করা এক কথা নয়। অনেক পার্থক্য। আর যেন স্কুল-কলেজ বন্ধ না করা হয়।

রূপনগর মনিপুর স্কুলের পাশে আদিল টেইলার্সের মালিক হাওলাদার মাসুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত দেড় বছরে আমাদের ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। যেই সময় কাজ ছিল না, সেসময় কারিগরের অভাব ছিল না। আর এখন স্কুল খোলার আগে থেকে শিক্ষার্থীদের ড্রেসের অনেক অর্ডার পেয়েছি। কিন্তু কারিগর না থাকায় কাজ তুলতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরও স্কুল কলেজ খোলা আমরা খুবই খুশি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা অবিভাবকদের সঙ্গে এলেও মেইন রোড থেকে স্কুলের সড়কে একা যেতে হচ্ছে। স্কুলের শিক্ষকরা মেইন রোড থেকে শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিচ্ছেন। স্কুলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয় করা হচ্ছে। হাতে দেওয়া হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। প্রত্যেককে মাস্ক পরা অবস্থায় স্কুলে প্রবেশ করতে হচ্ছে। প্রিয় শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষকদের পেয়ে শিক্ষার্থীদের উৎফুল্ল অবস্থায় দেখা গেছে।

মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ ফারহানা নার্গিস ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানার চেষ্টা করছি। প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের স্কুলে ঢোকার সময়ই হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের বসার ব্যাপারেও সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করা হবে। দীর্ঘদিন পর শিক্ষার্থীদের স্কুল প্রাঙ্গণে পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত।    

প্রাণঘাতী করোনা মহামারি থেকে স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে গত বছরের ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর সংক্রমণ পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি না হওয়ায় দফায় দফায় ছুটি বাড়ানো হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও কয়েক দফা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সবশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এ পর্যায়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক খুললেও বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে আগামী অক্টোবরের মধ্যে।

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, বেঞ্চের দৈর্ঘ্য ৫ ফুটের কম হলে প্রতিটি বেঞ্চে এক জন করে বসবে। কমপক্ষে একটি বেঞ্চ অন্তর অন্তর ৩ ফুট দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। যদি বেঞ্চগুলো সরিয়ে ফেলার পর্যাপ্ত জায়গা না থাকে, সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঞ্চে ’ক্রস’ মার্ক করে দিতে হবে, যাতে সেখানে কোনো শিক্ষার্থী বসতে না পারে। যদি বেঞ্চের দৈর্ঘ্য ৫ ফুট বা তার বেশি হয়, তবে প্রতিটি বেঞ্চে দুই জন করে বসতে পারবে। এছাড়া মহামারি পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি, অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠানপ্রধান, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, আঞ্চলিক উপপরিচালক, আঞ্চলিক পরিচালকদের ৬৩টি নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আজ স্কুল-কলেজ খুললেও সব শিক্ষার্থী একসঙ্গে যাবে না। শুধু ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন (সপ্তাহে ছয় দিন) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাবে। এদের সঙ্গে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির মধ্যে যে কোনো একটি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পর্যায়ক্রমে এক দিন করে যাবে। দুটি করে ক্লাস ধরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে রুটিন তৈরি করেছে।

এসআর/এসএম