বরিশালের বাকেরগঞ্জের পূর্ব চর গজালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তাসমিয়া জাহান সূচনা। করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুলের আঙিনায় পা রাখা হয়নি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্কুল খুললেও ডেঙ্গু বাধায় আবারও ঘরে। নতুন বছরে নতুন উদ্যমে যখন স্কুলে যাওয়া শুরু  হলো, তখনই ফের করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা। এতে চিন্তার ভাঁজ সূচনার মা ডেইজী আক্তারের কপালে।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে শোনালেন তার আশঙ্কার কথা। ডেইজী আক্তার বলেন, এর আগে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়ের পড়াশোনায় মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। তখন সে কার্টুন, মোবাইল গেম, টিকটক ভিডিও ইত্যাদিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। স্কুল খুললেও তার আসক্তি কমেনি। চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম তাকে পড়াশোনায় ফেরাতে। কিন্তু এর মধ্যে আবারও স্কুল বন্ধের ঘোষণা এলো।

অনলাইনে ক্লাস চালু থাকার কথা বলা হলেও সব জায়গায় নেটওয়ার্ক ভালো নয় জানিয়ে তিনি বলেন, অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মনোযোগও কম থাকে। আমার মনে হয়, অন্য সব প্রতিষ্ঠান যেহেতু খোলা আছে, স্কুলগুলোতেও একদম সীমিত পরিসরে সশরীরে ক্লাস নেওয়া উচিত।

শুধু সূচনার মা -ই নন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চিন্তিত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্তরের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে নানা শঙ্কার কথা।

অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার ফলে অনলাইনে ক্লাস চালু থাকলেও তাতে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ তেমন থাকে না। টানা মোবাইল বা কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে তাদের।  এই ছুটি যদি আগের মতোই দীর্ঘ হয়, তবে শিক্ষাব্যবস্থা  বড় হুমকির মুখে পড়বে।

করোনা সংক্রমণের মধ্যে সবকিছু খোলা রেখে শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা সঠিক সিদ্ধান্ত নয় বলে মনে করছেন অভিভাবকদের অনেকেই । তাদের দাবি, সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকুক। আবার কেউ কেউ দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকাকে স্বাগত জানালেও কালক্ষেপণ না করে দ্রুত স্কুল খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২১ জানুয়ারি থেকে দুই সপ্তাহের জন্য সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ সিদ্ধান্ত প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়েছে। এ ঘোষণার পর স্কুল-কলেজের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চালু থাকছে। যেখানে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা কম, সেখানে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। এসব ব্যবস্থা নেওয়ায় ক্লাস-পরীক্ষা চলমান থাকলেও শিক্ষার্থীদের মনোযোগের অভাবে মেধার যথার্থ মূল্যায়ন হবে না বলে মনে করছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা।

রাজধানীর দনিয়া এলাকার বর্ণমালা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী সিদরাতুল মুনতাহা বলে, স্কুল খোলা থাকলে বেশি ভালো লাগে। সামনে থেকে শিক্ষকদের সাথে কথা শুনতে পারি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারি। কিন্তু অনলাইন ক্লাস আমার কাছে একঘেয়েমি মনে হয়।

মুনতাহার বড় ভাই হাসিবুর রহমান সদ্য বিএসসি ইন টেক্সটাইল শেষ করেছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনার কারণে আমি প্রায় এক বছর পিছিয়ে গেছি। আমি চাই না আমার বোনের শিক্ষা কার্যক্রমও একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক।

তিনি বলেন, মুনতাহা সদ্যই অষ্টম থেকে নবম শ্রেণিতে উঠছে। এ শ্রেণিতে সবগুলো বিষয়ই তার কাছে নতুন। অনলাইন ক্লাসে মনোযোগের ঘাটতি থাকে। তাই এখন অনলাইনে ক্লাস করলে তার মাথায় কিছুই ঢুকবে না। বছরের শুরুতে যদি ঠিকমতো না পড়ে, তাহলে তো সে ক্ষতিগ্রস্ত হবেই।

একই সুর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র ফাহাদ ফারদিনের বড় বোন মারজান মালিয়া দিতির। তিনি বলেন, অনলাইন ক্লাস চলাকালীন অনেকেই অন্য সাইট ভিজিট করছে, ফাঁকিবাজি করছে। এর ফলে ক্লাসগুলো ফলপ্রসূ হয় না। তাই বেশি সময়ক্ষেপণ না করে সশরীরে ক্লাস শুরুর কথা ভাবতে হবে সরকারকে।

ফেনী সরকারি কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হাবিবা হুরেইন বলেন, আগের বর্ষের পরীক্ষা মাত্র শেষ হলো। দীর্ঘদিন অবসাদে থাকার পর যখনই সশরীরে ক্লাসে ফিরব ভাবছি, তখনই আবার অনলাইনে ক্লাসের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরকম সিদ্ধান্ত আরও বেশি অবসাদ তৈরি করছে। এদিকে, অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার কথা থাকলেও নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। ইন্টারনেট ডাটা কিনতে যে উচ্চ মূল্য, আমাদের প্রত্যন্ত এলাকায় অনেকেরই তা বহন করার সক্ষমতা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ইফরাত সিমি বলেন, আগের মতো এখন টিকার সমস্যা নেই। অনলাইন ক্লাসের সক্ষমতাও বেড়েছে। আবাসিক হল খোলা রয়েছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে অনলাইন ক্লাস নিয়ে আমার কথা রয়েছে। অনলাইন ক্লাসগুলো শিক্ষকরা তাদের মর্জিমতো নেন। এর ফলে সবাই একই সময় হলের ভেতর বা বাসায় অবস্থান নাও করতে পারে। ফলে ক্লাস মিস হতে পারে। এটি একটি কারণ। আরেকটি  হলো প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোতে দুর্বল হওয়ায় শিক্ষকদের অনেকেই বলেছেন, তারা অফলাইনে ক্লাস নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

তিনি বলেন, অনলাইন ক্লাসে আমাদের মধ্যে ফাঁকিবাজি করার মানসিকতা থাকে। অনলাইন ক্লাসে অনেকে উপস্থিতি নিশ্চিতের জন্য ক্লাস করে। উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে গেলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় বা ভিডিও অফ করে অন্য কাজ করে। সেজন্য অফলাইনের ক্লাস সবসময়ই স্বাচ্ছন্দ্যের।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. মিনহাজুল ইসলাম বলেন, দেশের সব কার্যক্রম সচল রেখে শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি আমার কাছে মোটেই ইতিবাচক মনে হচ্ছে না৷ অফলাইন ক্লাস যতটা ফলপ্রসূ হয়, তার তিনভাগের একভাগও পাওয়া যায় না অনলাইন ক্লাসে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ক্লাস করার মতো একটি ভালো ডিভাইস ও পর্যাপ্ত ডাটার অভাব রয়েছে৷ শিক্ষার্থীদের এসব সমস্যার কোনো সমাধান না করে হুটহাট অনলাইন ক্লাসের ঘোষণা দিলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে না বরং ক্ষতিগ্রস্তই হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হয়েছেন নেয়ামত হোসেন। ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের এ শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় এসেছি। এসেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ পেলাম। অনলাইনে ক্লাসের বিষয়ে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অনলাইন ক্লাস করে আমার মনে হয় না কোনো উপকার হবে। কারণ এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলো প্র্যাকটিক্যালি না করলে বোঝা যায় না। তাছাড়া অনলাইনে ক্লাসে মনোযোগও আসে না। আমার মনে হয়, দ্রুত অফলাইনে ক্লাস শুরু হলেই ভালো হয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আহসান জোবায়ের বলেন, করোনার কারণে এমনিতেই দুই বছর পিছিয়ে আছি। তৃতীয় বর্ষের একটি পরীক্ষার জন্য এক বছর ক্ষতি হয়েছে। আর এখন ফাইনাল ইয়ারে এক বছর বসে আছি। অনেকে শিক্ষকই অনলাইনে ক্লাস নিতে চান না। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে না, কিছু বুঝে না, তাই তারা চায় না অনলাইনে ক্লাস হোক।

ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান নাফিজ বলেন, অনলাইন ক্লাসে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া যায় না। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যোগ দিয়ে অন্য কাজ করে। মোটকথা ক্লাসের প্রতি আগ্রহ থাকে না। আর প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে মানসিকভাবেও শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পড়ায় মন বসে না। এমনিতেই আমরা দেড় বছর পিছিয়েছি। আর পেছাতে চাই না।

এদিকে, করোনার কারণে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা,যে কারণে দীর্ঘ সেশনজটের শঙ্কায়  শিক্ষার্থীরা। সেজন্য চলমান ও ঘোষিত পরীক্ষা স্থগিত নয় বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষার দাবিতে নোয়াখালী, রাজশাহী, কুমিল্লা, মাগুরা, পাবনা, রাঙ্গামাটি, যশোর, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, ফেনী সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতীকী পরীক্ষা, মানববন্ধন, বিক্ষোভ, অবস্থান ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক অফিস ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছেন বিভিন্ন কলেজের পরীক্ষার্থীরা। এ ছাড়া, ডিগ্রির চলমান পরীক্ষা স্থগিতের প্রতিবাদে রাজধানীর নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের ডিগ্রির শিক্ষার্থীরা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিক আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধুমাত্র অনলাইন-নির্ভর শিক্ষা কার্যক্রমের বেশকিছু সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমাদের ডাটা এক্সেস নেই, গেজেট নেই, প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তির ঘাটতি রয়েছে। অনেকটা সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত আমরা কারিকুলাম বাস্তবায়নে মনোযোগী হইনি। আমরা যদি শুধুমাত্র অনলাইনকে মাথায় রেখে এগিয়ে যাই, তাহলে এ চ্যালেঞ্জগুলো পূরণ করা সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ পূরণের জন্য ব্লেন্ডেড লার্নিংয়ের দিকে যেতে হবে। শুধুমাত্র মুখস্থ বিদ্যা নয়, অনলাইন ও অফলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে যাতে ব্লেন্ডেডভাবে চালানো যায়, সেজন্য পরিবার নির্ভর, সমাজ নির্ভর কিছু প্রজেক্ট- অ্যাসাইনমেন্ট থাকা দরকার। যেটা তাদের (শিক্ষার্থী) হাতে-কলমে করে জমা দিতে হবে। এটি করার জন্য কারিকুলামে যে ধরনের সংশোধন দরকার, তা করে ফেলা উচিত। ভবিষ্যতের শিক্ষা বলি বা করোনা পরবর্তী অবস্থার কথা বলি, কারিকুলামে এ রূপান্তর প্রয়োজন আছে।

অধ্যাপক তারিক আহসান বলেন, সবসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্ভর শিক্ষার বাস্তবতায় আমরা হয়তো দুটো কারণে কখনোই যেতে পারব না। কোভিডের প্রভাব তো আছেই, দ্বিতীয় হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসছে। আমরা অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি। যদি কারিকুলামে এ রূপান্তরগুলো করি তাহলেই যেকোনো পরিস্থিতিতে শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষার মান বজায় রাখা সম্ভব।

এএজে/আরএইচ