বয়স সবে ১২। এরই মধ্যে নিজেকে জানান দিয়েছেন একজন ক্ষুদে শিল্পী হিসেবে। মিলেছে স্বীকৃতিও। সম্প্রতি টফি স্টার সার্চ নামে একটি রিয়েলিটি শোতে সংগীত বিভাগে সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী হয়েও হয়েছেন প্রথম রানার আপ। পেয়েছেন ১৫ লাখ টাকা। বলছিলাম ময়মনসিংহের ঈশান দে’র কথা।  

করোনা মহামারির মাঝামাঝি সময়ে ঘরে বসে মোবাইলে রেকর্ডকৃত গান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেন ঈশান। সেসব গানে নেট দুনিয়ায় মুগ্ধতা ছড়াতে থাকেন ঈশান। এক এক করে প্রস্তাব আসতে থাকে জনপ্রিয় বিভিন্ন পেজের লাইভে গান গাওয়ার। এরপর বড় সুযোগ তৈরি হয় দেশের জনপ্রিয় ডিজিটাল স্ট্রিমিং অ্যাপ ‘টফি’র ফ্ল্যাগশিপ ট্যালেন্টহান্ট শো ‘টফি স্টার সার্চ’-এর মাধ্যমে। বাছাইকৃত সেরা ৩০ জনের একজন হিসেবে তিনি স্থান করে নেন ফাইনাল স্টুডিও রাউন্ডে। এরপরের গল্পটা শুধুই বিচারক আর শ্রুতা-দর্শকদের মন জয় করার।

নিজের প্রতিভার আলো ছড়িয়ে প্রথম রানার আপ হওয়ার স্বীকৃতি অর্জন করে দারুণ উচ্ছ্বসিত ঈশান বলেন, ‘এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেক গুণীজনের সামনে আমি পারফর্ম করতে পেরেছি, সেটাই ছিল আমার জন্য বড় প্রাপ্তি। তবে এতটুকু প্রত্যাশা আমার ছিল না। তবুও যে প্রথম রানারআপ হতে পেরেছি, তাতে আমি খুবই আনন্দিত।’

বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈশান

ঈশান বলে চলেন, ‘পুরস্কার পাওয়ার পর যখন আমি স্কুলে যাই তখন স্কুল থেকে আমাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় এবং সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সবাই আগ্রহ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতার কথা শুনেছে। সেই মুহুর্তটা আমার কাছে আরও ভালো লাগার ছিল।’

ছয় বছর বয়স থেকেই সুর, তাল, লয় রপ্ত করা শুরু করেন ঈশান। আর এটি সম্ভব হয়েছে সংস্কৃতিপ্রেমী পরিবারের সদস্য হবার কারণে। এই ক্ষুদে সংগীতশিল্পীর ভাষ্য, ‘আমি যখন ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হতে যাই, তখন প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে একটা গান শোনাতে বলেছিলেন। আমার বাসায় সারাদিনই গান চলার কারণে আমি ছোটবেলায়ই শুনে শুনে কয়েকটা গান মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। ওইদিন স্কুলে আমি আয় খুকু আয় এই গানটি স্যারকে শুনাই এবং স্যার খুব প্রশংসা করে। ওইদিন বাবা-মা ভাবলেন আমাকে গানে দেবেন৷ প্রথমত পিসিমণির কাছ থেকে হারমোনিয়ামে হাতেখড়ি তারপর প্রাথমিক শিক্ষা লাভের জন্য আমি আমার শ্রদ্ধেয় গুরুজি চয়ন সেন স্যারের কাছে তালিম নিলাম। বর্তমানে মামুনুল ইসলাম রনি স্যারের কাছে ক্লাসিক্যাল গান শিখছি এবং জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে চতুর্থ বর্ষে আছি।’

অন্য সবার মতো শাস্ত্রীয় সংগীতের মধুরতা আকৃষ্ট করে ছোট্ট ইশানকেও। এই ঘরানার গানে আলাদা দখল রয়েছে তার। এটি কীভাবে সম্ভব হয়েছে জানতে চাইলে ঈশান বলেন, ‘আমার পছন্দের তালিকায় আছে মান্না দে, হেমন্ত স্যারের বিভিন্ন আধুনিক ও সেমি ক্লাসিক্যাল গান। আর আর আমার বেশি ভালো লাগে ক্লাসিক্যাল, ঠুমরী, গজল এই আঙ্গিকের গানগুলিই। এসব গানের যে মধুরতা, তা অন্য কোনো গানের সাথে তুলনা করা যায় না। আমি সব ধরণের গানের মাধ্যমেই এগিয়ে যেতে চাই। তবে প্রাধান্য দিচ্ছি ক্লাসিক্যাল গানগুলিতে।’

গানের চর্চায় ব্যস্ত ঈশান

পড়াশোনার পাশাপাশি সংগীতকে সঙ্গী করেই এগিয়ে যেতে চান প্রতিভাবান এ কিশোর৷ অবদান রাখতে চান দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। ঈশান বলেন, ‘আমার বাবা মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল যেন আমি গান শিখতে পারি। আমারও যেহেতু গানের প্রতি ভালোলাগা রয়েছে তাই এই গানের মাধ্যমেই আমি এগিয়ে যেতে চাই। পড়াশোনার পাশাপাশি গানটাকে সবসময় সাথে রাখব। সংগীতে পিএইচডি করার ইচ্ছে আছে। একইসঙ্গে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করতে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব।’

ময়মনসিংহ নগরীর আকুয়ার এলাকার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম ঈশানের। বাবা স্বাধীন দে স্থানীয় একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আর মা শর্মিলা রানী সিংহ একটি কলেজের প্রভাষক। অবসরের প্রায় পুরোটুকুই তারা ঢেলে দেন সন্তানের সংগীত শিক্ষার কাজে। ঈশানের বাবা-মা মনে করেন, প্রত্যেক শিশুর জ্ঞান ও আত্মার বিকাশের জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি প্রয়োজন সংস্কৃতি চর্চার। তাহলেই শিশুরা ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে।   

ঈশানের বাবা স্বাধীন দে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ সবদিক থেকেই ভালো হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চা প্রতিটি শিশুর জন্য খুবই প্রয়োজন। ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে এই সংস্কৃতি অনেকভাবে সহযোগিতা করে। আমি আগে থেকেই গান পছন্দ করতাম। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই চেয়েছি আমার সন্তানের মাধ্যমেই নিজের আকাঙ্খা মেটাতে। এখন প্রত্যাশার চেয়েও সে ভালো করছে। বয়সের তুলনায় অনেক ভালো গাইছে।’

প্রতিনিধির মুখোমুখি ঈশান

মা শর্মিলা রানী সিংহ বলেন, ‘ঈশান যখন একেবারে ছোট ছিল, তখনই একটা বিষয় খেয়াল করেছি, সে প্রায়ই হারমোনিয়াম নিয়ে টুকটাক খেলা করতো। তাকে যখন আমি প্রথম স্কুলে নিয়ে যাই তখন সে আমার কোলে বসেই গান শিখেছে। ও শিক্ষককে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতো। আমার শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সবাই সংস্কৃতিমনা হওয়া সুবাদে ঈশানেরও পারিবারিকভাবেই গানের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। এখন সব জায়গাতেই ভালো পারফর্ম করা শুরু করেছে।’

ঈশানের শিক্ষক মামুনুল ইসলাম রনি বলেন, ‘ঈশান শুধু প্রতিভাবানই না, তার মধ্যে চেষ্টা ও সাধনা আছে। সবকিছু মিলিয়েই সে এগিয়ে যাচ্ছে। এই বয়সেই তার যে অর্জন এবং ভবিষ্যতের জন্য যে মানসিক প্রস্তুতি, দুটিই আমাদের আশান্বিত করছে৷ আমাদের প্রত্যাশা ঈশানের সংগীতজীবন খুবই সুন্দর হয়ে উঠবে।’

ময়মনসিংহের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ঈশান। বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর পদকের মতো জাতীয় পুরস্কার ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ইতোমধ্যে এই ক্ষুদে শিল্পীর সাফল্যের ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে ত্রিশটি পদক ও সনদ।

উবায়দুল হক/কেআই