সিয়াম আহমেদ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিকে অভিনয় করার জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারি মুম্বাই গেছেন সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা সিয়াম আহমেদ। সেখানে এক সপ্তাহ ধরে ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের সিনেমাটির শুটিংয়ে অংশ নেবেন তিনি। যাওয়ার আগে কথা বলেছেন ‘ঢাকা পোস্ট’-এর সঙ্গে। লিখেছেন রবিউল ইসলাম জীবন

‘বঙ্গবন্ধু’ সিনেমার জন্য কবে চূড়ান্ত হয়েছিলেন? কীভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হলেন?
মাসখানেক আগে, তারিখটা সঠিক মনে নেই। একটি পোস্ট দেখে মূলত বিষয়টি জানতে পারি। সেখানে শিল্পীদের চূড়ান্ত একটা তালিকা ছিল। তার আগেও যখন রিহার্সেল হয় তখন আমি ঢাকার বাইরে শুটিংয়ে ছিলাম। তখন আমরা জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে সিনেমার পরিচালক শ্যাম বেনেগাল স্যারের সঙ্গে স্ক্রিপ্ট রিডিং সেশনটা করেছি।

এই সিনেমায় আপনার চরিত্র তো প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শামসুল হকের। নিজেকে কীভাবে তৈরি করেছেন?
আমি তার পরিবারের সদস্যদের নাম্বার ম্যানেজ করেছি। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কেমন ছিলেন তা জানার চেষ্টা করেছি। তার আচরণের ধরণ কেমন ছিল, গলার স্বর কেমন ছিল অথবা কোন স্কেলে কথা বলতেন, রাগী ছিলেন নাকি শান্ত স্বভাবের, দাঁড়িগোফ রাখতে পছন্দ করতেন কি না, কি কাপড় পরতেন, কি খাবার খেতে পছন্দ করতেন তার রিলেশনশিপটা কি রকম ছিল, পলিটিক্স তার কাছে কি মিন করতো, কিভাবে ভাষা আন্দোলনের জন্য কাজ করেছেন, কিভাবে সাংগঠনিকভাবে রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন-সব কিছু জানার চেষ্টা করেছি। বঙ্গবন্ধু থেকে বয়সে একটু বড় ছিলেন তিনি, ভাসানী সাহেবকে আবার নিজের পিতৃতুল্য মনে করতেন। আমার সিকুয়েন্স যেহেতু বঙ্গবন্ধু এবং ভাসানী সাহেবের সঙ্গে সেই জায়গা থেকে তার কথা বলার ধরনটা কি সেটাও জানা দরকার ছিল। সেভাবেই তাকে জানার চেষ্টা করেছি।

শামসুল হককে ধারণ করতে গিয়ে তার কোনো কিছু কি আপনার জীবনে প্রবেশ করেছে?
উনি সাংঘাতিক দেশ প্রেমিক ছিলেন। উনি জানতেন একটা স্বাধীন বাংলাদেশ হবে। নিজের কথা না ভেবে বারবার মিছিল করতে গিয়ে ধরা পড়া থেকে শুরু করে উনারা জানতেন আমাদের জন্য সময়টা খুব কঠিন যাবে। তারপরও পিছু হটেননি। তার দেশপ্রেমের বিষয়টি আমাকে অবাক করে। তার কাছ থেকে সেই দেশপ্রেমটাই নিজের ভেতর আনার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশের স্থপতিকে নিয়ে এই সিনেমা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরিসরের সিনেমাও হতে যাচ্ছে এটি। তা নিশ্চয়ই আপনার জন্য বাড়তি একটা অনুপ্রেরণা। একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জও কি না?
তা তো অবশ্যই। তবে আমি চ্যালেঞ্জ নিতে চাইনি। নিজের ভালোলাগা এবং ভালোবাসা থেকেই কাজটি করতে চাইছি। এখানে আমি কোনো লিড চরিত্র অভিনয় করছি না, অতিথি চরিত্র করছি। আমাদের অনেক সিনিয়র এবং অসাধারণ শিল্পীরা এতে অভিনয় করছেন। এমন একটি প্রজেক্টের সঙ্গে থাকতে পারা কিংবা শ্যাম বেনেগাল স্যারের সঙ্গে কাজ করতে পারা, বঙ্গবন্ধুর জীবনটাকে একবার কাছ থেকে উপলব্ধি করা-এগুলো অবশ্যই আমার ক্যারিয়ারের জন্য অনেক বড় একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে।

অভিনেতা হিসেবে বলতে গেলে এখন সেরা সময় পার করছেন। যতদূর জানি আপনার হাতে এখন ডজনখানেক সিনেমা!
সত্যি বলতে এই সংখ্যাটা আমার ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ (হাসি)। নতুন আরও তিনটি প্রজেক্টের কথা হচ্ছে। সেগুলো যোগ হলে ১৫টি হয়ে যাবে। সর্বশেষ আমি যুক্ত হয়েছি ‘মৃধা বনাম মৃধা’র সঙ্গে। করোনাকাল শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি ২৮টা পাণ্ডলিপি পড়েছি। এত কম সময়ে প্রযোজক-পরিচালকরা আমার ওপর আস্থা রাখছেন, এত বড় বড় প্রজেক্টের দায়িত্ব দিচ্ছেন এটা অবশ্যই আমার জন্য বড় প্রাপ্তি। করোনার মধ্যেই ‘বিশ্বসুন্দরী’ মুক্তি পেল। আমরা জানতাম সময়টা খারাপ। তারপরও দুই মাসের বেশি সময় ধরে সিনেমাটি হলে চলছে। গতকাল শুনেছি আরও নতুন ১০টি হল যুক্ত হয়েছে। তাও দুই মাস পরে এসে, করোনার মধ্যে! এই বিষয়গুলোই জানান দেয় কোথাও কেউ আছে যারা আমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করে।

এগুলো নিশ্চয়ই খুব ভালোলাগার অনুভূতি। করোনার মাঝে একবার আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তখন কিন্তু কাজ নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলেন।
সেটা তো অবশ্যই থাকবে। সত্যি কথা হচ্ছে যখন যেটা করতে চাচ্ছি তখন সেটা করতে না পারলে খুব খারাপ লাগে। কারণ আমি জানি কাজের জন্য অনেক রাত ঘুমাতে পারিনি। নিজের পরিবার-আত্মীয়স্বজন অনেক কিছু সেক্রিফাইস করেই কিন্তু কাজ করা। যাদের জন্য কাজ করছি যাদের পর্যন্ত কাজটা কতটা পৌঁছাতে পেরেছি এই চিন্তা আমার সব সময়ই থাকে। কাজ দিয়ে তো বেঁচে থাকতে হবে।

২০২১ সালে আপনার কোন কোন সিনেমা মুক্তি পাবে?
ইনশাআল্লাহ রোজার ঈদে আসবে ‘শান’। কুরবানির ঈদে আসতে পারে ‘অপারেশন সুন্দরবন’। এর মাঝখানে আসতে পারে ‘পাপ-পুণ্য’। ‘অ্যাডভেঞ্জার অব সুন্দরবন’ পুরোপুরি রেডি। যেটা মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের গল্পে অনুদানের চলচ্চিত্র। স্বাধীনতা দিবসে আসার কথা ‘দামাল’। এটা সম্পূর্ণ দেশাত্মবোধক সিনেমা। যতটুক কাজ বাকি সেটা যদি শেষ করতে পারি তাহলে মাঝখানে আসবে ‘ইত্তেফাক’। ‘স্বপ্নবাজি’ও আসার সম্ভাবনা আছে। ডিসেম্বরকে টার্গেট করে আরও দুটি সিনেমায় সাইন করেছি। কাজ সম্পূর্ণ করা গেলে সেগুলোও আসতে পারে। ওয়েব সিরিজি হিসেবে ‘মরিচীকা’ আসবে চরকি প্ল্যাটফর্মে। ‘মৃধা বনাম মৃধা’ এ বছর যদি না আসে সেক্ষেত্রে পরের বছর আসবে।

২০১৮ সালে প্রথম সিনেমা ‘পোড়ামন ২’ দিয়েই আলোড়ন তুলেছিলেন। প্রায় তিন বছর পর নিজের সঙ্গে নিজের মূল চ্যালেঞ্জটা কী? 
তখন সিয়াম আহমেদের কাঁধে কয়েক কেজির বোঝা ছিল, এখন কয়েক মণের। তবে সেটা খুব পজিটিভ বোঝা। আমি যখন কোনো প্রোগ্রাম, ফ্যামিলি গ্রোগ্রাম বা গেট টুগেদারে যাই, রাস্তায় যখন শপিং করি, বাজার করি তখন আমার আশেপাশের সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষ, স্টুডেন্টস, মা’রা অনেক ইতিবাচক মন্তব্য করেন। খুব খেয়াল করেছি বাইরের মা-দাদিরা আমাকে খুব পছন্দ করছেন। তারা এমনভাবে গায়ে হাত দেন, মনে হয় নিজের ছেলে বা নাতিকে আদর করছেন। সবাই বলছেন, ‘ভালোভাবে কাজ করো, নিজের যত্ন নিও।’ এটা অদ্ভূত ধরনের একটা মায়া। আমি এটাও জানি পৃথিবীতে কোনো কিছুই সারা জীবনের জন্য নয়। সেই জায়গা থেকে আমার এখনই ভয় লাগে, যেদিন এই মায়ার ঘোর থাকবে না সেদিন কিভাবে বাঁচবো! মানুষের এত ভালোবাসা পাবো জীবনেও ভাবিনি।

বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আপনি এই অবস্থানে এসেছেন। নিশ্চয়ই নিজের জায়গাটাও সেভাবে সামলাবেন।  
(আল্লাহ মাফ করুক) প্রত্যেকটা ধাপ দেখে আসছি দেখেই হয়তো আমার এই ধাপ থেকে নামতেও সময় লাগবে!

স্বপ্নের একটা সিনেমার কথা বলুন। যে সিনেমা আপনার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়! 
আমার তো মনে হয় স্বপ্নের মধ্যেই সিনেমা করছি। আমি চাই এই স্বপ্নটা না ভাঙুক।

যদি কোন চরিত্রের কথা বলি! যেমন চরিত্র করতে চান।
আমি যখন যে স্ক্রিপ্টটা সিলেক্ট করি সেই স্ক্রিপ্টের পেছনে একটা কারণ থাকে। কোনো স্ক্রিপ্ট মনের সঙ্গে মিলে গেলে সেখানে আমার চরিত্র একটু কম থাকলেও সমস্যা নাই। যখন যেই স্ক্রিপ্ট বা চরিত্র ফাইনাল করি আমার কাছে তখন মনে হয় এটাই আমার স্বপ্নের চরিত্র। এটাই আমি করতে চেয়েছিলাম। প্রত্যেকটা কাজের আগে আমি নিজেকে বলি যে, এমনভাবে কাজটি করো, যেন এটাই শেষ কাজ।

শুটিং না থাকলে কী করেন?
আমি যাদের কাছ থেকে অভিনয় শেখার চেষ্টা করি আমার সেই মেন্টরদের সঙ্গে কথা বলি, তাদের বাসায় যাই। তাদেরকে অনুরোধ করি আমাকে আধাঘণ্টা একঘণ্টা সময় দেওয়ার জন্য।

আপনার সেই মেন্টর কারা?
তিনজন মানুষের নাম একবারে মোটা করে বলতে হবে। যারা আমাকে শুরু থেকেই খুব হেল্প করেন। সবার প্রথম আমি এই সহযোগিতা পেয়েছি আজাদ আবুল কালাম পাভেল ভাইয়ের কাছ থেকে। এটা অনস্বীকার্য। এরপর দীর্ঘ দেড় থেকে দুই মাস সহযোগিতা পেয়েছি আশীষ খন্দকারের কাছে। সেটাও কাজ করতে গিয়েই। সর্বশেষ যাকে পেয়েছি, যিনি নিজের সর্বস্বটা দিয়ে আমাকে শেখাতে চান তিনি হলেন তারিক আনাম খান। আমি জানি না একটা মানুষ কিভাবে এতটা সার্পোটিভ হয়। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তাদের কাছ থেকে সার্পোটটা পাওয়ার পর নিজের প্রত্যেকটা কাজের প্রার্থক্য বুঝতে পারছি। এতদিন চিন্তা-ভাবনা হয়তো অন্যরকম ছিল।

পরিবারের সার্পোটও তো অনেক পান নিশ্চয়ই। বিশেষ করে আপনার স্ত্রীর।
একটা গোপন তথ্য দেই-আমার প্রত্যেকটা স্ক্রিপ্টের প্রথম শ্রোতা হচ্ছেন আমার স্ত্রী। সে যদি আমাকে পাস মার্ক দেয় তাহলে আমি মনে করি যে সেটা সুপার-ডুপার হিট হবে। এখন পর্যন্ত কোনোটাতে খুব বেশি একটা পাস মার্ক দেয়নি। সামনে দুই একটা প্রজেক্ট আছে যেগুলোতে ৬০-৬৫ পেতেও পারি বলে জানিয়েছে সে। তখন আমি বুঝেছি একটু একটু করে আগাচ্ছি।

আর বাবা-মার সার্পোট?
আব্বু হচ্ছেন আমার প্রথম সমালোচক। বাবা-মা আমার ভালোটাকে ভালো বলতে যেমন কার্পণ্য করেন না আবার খারাপটাকে খারাপ বলতেও দ্বিধা করেন না। ভালো কাজ করার জন্য, নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটা খুব জরুরি।

আরআইজে