‘সোলস’, ‘ফিডব্যাক’, ‘ওয়ারফেজ’, ‘দলছুট’ ব্যান্ড সংগীতের জনপ্রিয় নাম

ব্যান্ড মিউজিকের সেই স্বর্ণালী সময় এখন আর নেই। কনসার্ট না হওয়া, গান প্রকাশের মাধ্যমের পরিবর্তন, আয়োজকদের অবহেলাসহ নানান কারণের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে তারুণ্যের প্রিয় ব্যান্ড সংগীতকে। সেসব বিষয় উঠে এসেছে এই লেখায়। 

বাংলাদেশে ব্যান্ড কালচার স্বাধীনতার আগে থেকেই ছিল। কিন্তু সেটা ছিল খুব সীমিত আকারে। নির্দিষ্ট জায়গায়, ফাইভ স্টার হোটেল কিংবা বড় লোকদের কোনো অনুষ্টান বা পার্টিতে ব্যান্ডের গান হতো। তবে স্বাধীনতার পরপর এটা আরও ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। সে হিসেবে ব্যান্ড সংগীতকেও স্বাধীনতার ফসল বলা যায়। 

মাইলস 

বাংলা গানে যে আধুনিকতা, আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া সেটা কিন্তু আমার মনে হয় ব্যান্ডই প্রথম শুরু করে। তবে জোয়ারটা আসে স্বাধীতার পরপরই। আন্ডারগ্রাউন্ড পিস লাভারস, আগলি ফেইজেস, উইন্ডলি সাইড অব কেয়ার, রেম্বলিং স্টোনস প্রভৃতি ব্যান্ড ঢাকায় ব্যান্ড কালচারটাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করে। আজম খান (উচ্চারণ), পিলু মমতাজ, ফকির আলমগীর, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ (স্পন্দন), সোলস আমাদের ব্যান্ড মিউজিকটাকে হাঁটে, মাঠে, ঘাটে পৌঁছে দিয়েছে। যার ফলে ব্যান্ড মিউজিক সার্বজনীন একটা রূপ নিয়েছে। 

রেনেসাঁ

এই উপমহাদেশে বাংলাদেশের ব্যান্ড কিন্তু অনেক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ব্যান্ড সংগীত ওয়েস্টার্ন সংস্করণ হলেও আমরা আমাদের কালচারের সঙ্গে এটাকে সম্পৃক্ত করেছি। স্বাধীনতার আগে আমার শহর চট্টগ্রামে ‘লাইটিনিংস’ নামে একটা ব্যান্ড প্রথম যাত্রা শুরু করে। যদিও তারা ইংরেজি গান করতো। ১৯৭২ সালে আমরা তিন ভাই ‘বালার্ক’ নামে একটা ব্যান্ড গড়ি। ১৯৭৩ সালে যাত্রা শুরু করে ‘সুরেলা’। ১৯৭৪ সালে নামটি পরিবর্তন করে হয়ে যায় ‘সোলস’। তখন থেকে আমরা (সোলস) মৌলিক গান গাওয়া শুরু করি। একদিকে ঢাকায় আজম খানদের ব্যান্ড, অন্যদিকে চট্টগ্রামে আমাদের ব্যান্ড। দুই ব্যান্ড আলাদা আলাদা ঢঙে গান করতে থাকে। এরপর থেকেই মূলত সারাদেশে ব্যান্ড মিউজিকের একটা জোয়ার শুরু হয়। 

ঢাকা, চট্টগ্রামের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ড মিউজিক হয়। খুলনা, বগুড়া, রাজশাহীতে ব্যান্ড গড়ে ওঠে। তখন এমন কোনো কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না যেখানে ব্যান্ডের গান হতো না। চট্টগ্রামে এমন কোনো বিয়ে হতো না যেখানে গায়ে হলুদে ব্যান্ড থাকতো না। তার মানে ব্যান্ডের এই জনপ্রিয়তা অত্যন্ত তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত কনসার্ট হতো। এটা খুব জোরালো ছিল একটা সময় পর্যন্ত। 

অবসকিওর

আগে আমরা নিয়মিত ক্যাসেট বা অ্যালবাম পেতাম। অনুষ্ঠান হতো, কনসার্ট হতো। একটা মাত্র টিভি চ্যানেল ছিল-বিটিভি। যে কোনো অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল ব্যান্ড মিউজিক। কিন্তু ধীরে ধীরে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়গুলোরও পরিবর্তন হতে থাকে। একক শিল্পীরা সামনে আসতে থাকে। সারা পৃথিবীতেই একক শিল্পীদের আদিপত্য বাড়তে থাকে। একক শিল্পীরা স্টেজে যে ফর্মে গান করেন সেটাও কিন্তু ব্যান্ড ফর্মই বেশিরভাগ। 
এমন নয় যে ব্যান্ড মিউজিক জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে কিংবা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মূল কারণটা হচ্ছে পরিস্থিতি। কনসার্ট না হওয়া, ক্যাসেট বা সিডি বের না হওয়া বড় কারণ। এখনও যদি কনসার্ট ওপেন করা হয় এবং আগের সংস্কৃতি ফিরে আসে তাহলে ব্যান্ড মিউজিক ঠিকই পুরনো অবস্থায় ফিরে আসবে। মানুষের দৃষ্টি থেকে ব্যান্ড খানিকটা দূরে সরে যাওয়ার জন্য আসলে ব্যান্ড দায়ী না, দায়ী আমাদের পরিবেশ। 

আর্টসেল

অনেকে বলেন আগে ব্যান্ডে ভালো গান হতো, এখন হচ্ছে না। এটা আমি মানতে রাজি না। ব্যান্ড সংস্কৃতি হচ্ছে প্রবাহমান। এটা যুগের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হবে, এটাই স্বাভাবিক। ব্যান্ডকে আমি বলি তারুণ্যের সংগীত। এই তারুণ্য সব নিয়ম ভেঙে নতুন কিছু করতে চায়। এটাই হওয়া উচিত, এটাই হয়ে আসছে। 

আগে যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় কনসার্ট হতো, এখন হয় না। এটা নিরাপত্তার কারণে হতে পারে, অর্থনৈতিক কারণে হতে পারে। উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক কিন্তু অনেক এগিয়ে। তারপরও আমরা অবেহেলার শিকার। দেশে বড় কোনো আয়োজন বা কনসার্ট হলে ব্যান্ডগুলোতে ডাকা হয় না। যেটার জন্য দায়ী আয়োজকরা। যারা আয়োজন বা স্পন্সর করে তাদের কিন্তু সেই পরিকল্পনা থাকা উচিত। কেনো জানি না ব্যান্ড মিউজিককে তারা সামনে আনতে চায় না। জনপ্রিয়তা কিংবা পারফরমেন্স উভয় ক্ষেত্রেই কিন্তু ব্যান্ড অনেক এগিয়ে। 

চিরকুট

এখনও যদি ওপেন কনসার্ট হয় ব্যান্ডের গান শুনতেই কিন্তু মানুষ বেশি আসবে। যারা কর্ণধার, যারা এ ধরনের অনুষ্ঠান করে তাদের বোঝার ব্যাপার আছে। তারা আসলে কি চায় আমি বুঝি না। মাঝে মাঝে এগুলো চিন্তা করলে খুব কষ্ট লাগে। আমরা বাইরের দেশ থেকে শিল্পী আনি কিন্তু নিজ দেশের ব্যান্ডগুলোতে প্রমোট করি না। এটা আমাদের প্রত্যেকটা ব্যান্ড মিউজিশিয়ানের আক্ষেপ। যোগ্যতা থাকা শর্তেও আমরা যোগ্য সম্মান, সম্মানী কিংবা ট্রিটমেন্ট পাই না। বিদেশে গেলে আমরা যে পরিমাণ সম্মানিত হই চিন্তার বাইরে। অথচ সেই সম্মানটুকু দেশে পাই না। এটা খুবই দুঃখজনক। 

লেখক : ‘রেনেসাঁ’ ব্যান্ডের গায়ক  

আরআইজে