কোলাজ: ঢাকা পোস্ট

হাওয়া। উত্তাল সমুদ্রে চিত্রায়িত সিনেমা। নামেও আছে প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক। হয়ত সেজন্যই সিনে জগতে দোলা দিচ্ছে এটি। না, অলৌকিক সমীকরণে নয়, বরং গল্প, নির্মাণশৈলি আর অভিনয়ের জাদু দিয়েই ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে এই সিনেমা।

আগামী শুক্রবার (২৯ জুলাই) থেকে দেশের ২৪টি প্রেক্ষাগৃহে বইবে ‘হাওয়া’। এর প্রাক্কালে ঢাকা পোস্ট যোগাযোগ করেছে ‘হাওয়া’র কারিগরের সঙ্গে। তিনি মেজবাউর রহমান সুমন। গুণী এই নির্মাতা তার প্রথম সিনেমার পাশাপাশি দ্বিতীয় সিনেমার খবরও দিলেন। জানা গেল ‘হাওয়া’ থেকে পাওয়া আরও অনেক কিছু। 

মুক্তির আগেই ‘হাওয়া’ নিয়ে চারদিকে এত আগ্রহ-উচ্ছ্বাস দেখে কি বাড়তি চাপ অনুভব করছেন?

হ্যাঁ। এটা বিশাল চাপ। দর্শকের প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়া মানে নির্মাতার জন্য বাড়তি চাপ তৈরি হওয়া। তবে একটা বলতে চাই, আমি আমার মতো করে সিনেমাটি বানিয়েছি। ট্রেলার দেখে যদি কারো ভালো লাগে, পুরো সিনেমা দেখার আগ্রহ হয়, তারা দেখবে। ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি দেশের মানুষ পছন্দ করেছে। কিন্তু একটা গান হিট হলেই সিনেমা হিট হবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না।

সিনেমা মুক্তির পর দর্শকের এই উচ্ছ্বাস থাকবে?

এটা তো আসলে বলা মুশকিল। আমার জায়গা থেকে আমি বলতে পারি, ‘হাওয়া’ কোনো বাণিজ্যিক সিনেমা না। তার মানে এটা নয় যে, এখানে কোনো বাণিজ্যিক উপাদান নেই। আছে; তবে আমরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সিনেমাটি বানাইনি। আমাদের এখানে কোনো সিনেমা যখন আর্টিস্টিক জায়গা থেকে বানানো হয়, তখন সবাই ধরে নেয়, এটা গণমানুষের সিনেমা না। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। সাধারণ দর্শক আর ইন্টেলেকচুয়াল দর্শকের দুই ধরণের ভাবনা এবং সেটা বিপরীতমুখী। কোনো সিনেমা যখন ইন্টেলেকচুয়াল মানুষের কাছে ভালো লাগে, তখন সাধারণ দর্শক মনে করে, এটা তাদের সিনেমা না। আবার কোনো সিনেমা যদি সাধারণ দর্শক খুব পছন্দ করে, তখন ইন্টেলেকচুয়ালরা মনে করে, সিনেমায় হয়ত গভীরতা নেই। ‘হাওয়া’ নির্মাণের সময় আমি এসবের কিছুই মাথায় রাখিনি। সিনেমাটির কাজ তো আরও তিন বছর আগেই করেছি। এই ফাঁকে আমি কাছের কিছু মানুষকে এটা দেখিয়েছি। তারা দেখার পর বলেছে, এই সিনেমা যদি সাফল্য পায়, তাহলে বোঝা যাবে এখানে নতুন ধরণের সিনেমা বানানো যায়, নতুন ধাঁচের গল্প বলা যায়।

‘হাওয়া’ সিনেমার শুটিংয়ের চিত্র

ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘পরাণ’ ব্যাপক সাড়া পাচ্ছে। এই সিনেমার জনপ্রিয়তা কি ‘হাওয়া’র ওপর প্রভাব ফেলবে?

আমি আসলে এসব ভাবি না। তাছাড়া সিনেমার রাজনীতিও বুঝি না। আমার সিনেমা যদি কেউ না দেখে, কোনো সমস্যা নেই। আমি ‘হাওয়া’ বানিয়েছি আমার জন্য এবং সামনেও সিনেমা বানাবো আমার জন্যই। যদি কেউ আমার সিনেমার সমালোচনা করে, আমি খুশি। আর যদি ভালো বলেন, তাহলে অবশ্যই বেশি খুশি হবো। সমালোচনা শুনতে হয়ত খারাপ লাগবে, কিন্তু আমি শুনতে চাই।

২৪ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে ‘হাওয়া’। আপনি কি এতে সন্তুষ্ট?

আমরা আসলে বেশি হলে মুক্তি দিতে চাচ্ছি না। কারণ বেশিরভাগ সিঙ্গেল স্ক্রিনে মানসম্মত ব্যবস্থা নেই। যদি পরে দর্শক দেখতে চায়, তাদের আগ্রহ-চাহিদা বিবেচনা করে অন্যান্য জায়গায় মুক্তি দেওয়া হবে।

গল্প নিয়ে তো সবসময় চর্চা করেন। 'হাওয়া'কে কেন নিজের প্রথম সিনেমার গল্প হিসেবে বেছে নিলেন?

মাঝে আমি প্রায় ১২ বছর গল্প-সিনেমা-নাটক থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। কেবল বিজ্ঞাপনের কাজ করেছি। ‘হাওয়া’র গল্পটা কেন বেছে নিয়েছি, এই প্রশ্নের উত্তরটা আসলে নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। এটা একটা খেয়াল বলা যেতে পারে। যেমন একটা মানুষ গান গায়; কেন গায়? সেটা কিন্তু বলতে পারবে না। কয়েক বছর ধরে আমি এই গল্পটা নিয়েই কাজ করেছি। এটা প্রথমে শহরতলী কেন্দ্রিক ছিল। তবে কেন জানি ভালো লাগছিল না। পরে গল্পটা সমুদ্রে চলে যায়।

সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়া ছাড়া এই সিনেমা নিয়ে আর কী কী প্ল্যান আছে? মানে বিদেশে মুক্তি বা আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নেয়ার ব্যাপারে...

সত্যি বলতে আমাদের ইচ্ছে ছিল বিভিন্ন উৎসবে যাওয়ার। কিন্তু মহামারির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। কিছু টেকনিক্যাল কাজ বাকি ছিল। সেজন্য যেতে পারিনি। এদিকে অনেকদিন ধরে সিনেমাটি আটকে আছে, তাই রিলিজের সিদ্ধান্ত নিই। তবে পরবর্তী সিনেমায় চিন্তাভাবনা আছে ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার।

নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন

তার মানে নতুন সিনেমা নিয়ে ইতোমধ্যে পরিকল্পনা করে ফেলেছেন?

হ্যাঁ, এটা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু এখন বলতে চাই না। এটুকু বলি, এটা আমার খুব ব্যক্তিগত সিনেমা। ‘হাওয়া’ অনেক বড় পরিসরের সিনেমা। বিশাল প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল আমাদের। সমুদ্রে শুটিং করতে অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছিল। এখন যেমন কেউ সমুদ্রে শুটিং করতে গেলে অন্তত একটা রেফারেন্স পাবে- ‘হাওয়া’ শুট করেছে। কিন্তু আমাদের জন্য খুব কঠিন ছিল। সেকেন্ড সিনেমাটি খুবই সিম্পল। এক কথায় বলতে গেলে দুটি চরিত্রের গল্প। ‘হাওয়া’ রিলিজের পর ওটার কাজ শুরু হবে। আগামী বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

দর্শকের জন্য সিনেমা নাকি সিনেমার জন্য দর্শক-আপনি কোনটা মনে করেন?

দুইরকম সিনেমাই হয়। এক্ষেত্রে আমি আমার ভাবনাটা বলি; কোনো আবিষ্কার বা শিল্পকর্ম কখনোই কাউকে মাথায় নিয়ে হয় না। কোনো আবিষ্কার কেউ এককভাবেই করে; সমষ্টিগতভাবে সেটার প্রচার-প্রসার হতে পারে। ধর্মগ্রন্থ শুরু করে বিজ্ঞান; সবকিছুই একটা একক জায়গা থেকে শুরু হয়েছে। সিনেমা একটি সমষ্টিগত কাজ বটে। অনেক মানুষ মিলে কাজটি করেন, অনেকের পরিশ্রম, মেধা, জ্ঞান লাগে। কিন্তু এটার মূল চিন্তাটা একক জায়গা থেকে শুরু। পেইন্টিং, কবিতা বা অন্যান্য শৈল্পিক কাজের মতোই। সিনেমার ক্ষেত্রে এই একক মানুষটি হলো নির্মাতা। হ্যাঁ, অনেক নির্মাতা আছেন, যারা অন্যের গল্প-চিত্রনাট্যে কাজ করেন। আমি তাদের কথা বলছি না। আমি বলছি, যারা চিত্রনাট্য ও পরিচালনা নিজেই করেন। তিনি আসলে নিজের চিন্তাপ্রসূত উপলব্ধি বা দর্শনগত দৃষ্টিভঙ্গি সিনেমার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এটা মানুষ দেখে, দেখার পর ভালো লাগা, খারাপ লাগে ব্যাপারগুলো আসে। আর দর্শকের কথা মাথায় রেখে যেসব সিনেমা হয়, সেগুলো তো বাণিজ্যিক বা ফর্মুলা সিনেমা।  

কেআই/আরআইজে