মাইহার ধ্রুপদ ঘরানার শাস্ত্রীয় যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী পণ্ডিত দিশারী চক্রবর্তী। যার জন্ম ভারতের কোলকাতায় হলেও বাবা-মার পরিবারের নিবাস ছিল বাংলাদেশে। গুণী এই শিল্পীর মায়ের পরিবার অবিভক্ত বাংলাদেশের কুমিল্লায় এবং বাবার পরিবার ২০০ বছর আগে নারায়ণগঞ্জে বসবাস করতেন। সে সূত্রে তিনি নিজেকে একজন বাংলাদেশের মানুষ হিসেবেই ভাবেন। 

পণ্ডিত দিশারী চক্রবর্তী বলেন, বাংলাদেশ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আঁতুড়ঘর। এখানে জন্ম নিয়েছেন বাংলার সব বিখ্যাত পণ্ডিতগণ। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ এই বাংলাদেশে না জন্মালে আমার হয়তো আজকের আমি হয়ে ওঠা হতো না। আমার গুরুদক্ষিণা হিসেবে বাংলাদেশে আমার শাস্ত্রীয় যন্ত্রশিক্ষা ছড়িয়ে দিতে চাই। যাতে বাংলাদেশ থেকে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের নাম কখনো মুছে না যায়।

বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় যন্ত্রসঙ্গীতের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জলবায়ু সঙ্গীত সৃষ্টির জন্য অনুকূল। এখানে প্রকৃতি নিজেই প্রতিনিয়ত সঙ্গীত সৃষ্টি করে। আমার শিক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যেই ব্যাপক সম্ভাবনা দেখেছি। শুধু দরকার সঠিক শিক্ষা এবং দিক-নির্দেশনা। তবে একটি বিষয়ে আমি খুবই মর্মাহত। তা হলো আমি যে যন্ত্রটা বাজাই, বাংলাদেশে এই যন্ত্র বাজানোর কোনো যন্ত্রী নেই। একটি দেশ থেকে এইরকম একটি যন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে গেছে যা খুবই দুঃখজনক। আমি চাই এর ওপর আগ্রহ নিয়ে কেউ একজন আসুক, আমি তাকে শিখাতে চাই।

তিনি মনে করেন সঙ্গীত বলতে শুধুমাত্র কয়েকটা স-র-গ-ম তাল লয় এবং রাগ-রাগিণী নয়। সঙ্গীত একটা বোধ, চেতনা যা মানুষকে দেয় “সেন্স অব এসথেটিক্স”। এছাড়া সঙ্গীত শেখায় মানুষের প্রতি মানুষের সহনশীলতা যা বর্তমান সমাজে অনেক কম দেখা যায়। সমাজে সঙ্গীত চর্চা যত বাড়বে, তত বেশি শুদ্ধ চেতনার ও মানবিক সমাজ গড়ে উঠবে। শুদ্ধ সঙ্গীত চর্চা করতে হলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা বাড়াতে হবে। কারণ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে বলা হয় মাদার অব মিউজিক। তাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছাড়া সঙ্গীত শুদ্ধ হয় না।

প্রাচীনকালে শিষ্যরা গুরুর বাড়িতে থেকে শিক্ষা অর্জন করতেন। বর্তমান যুগেও সেই ধারা বজায় রেখে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে এমন ঘটনা বিরল। সেই অভাবনীয় কাজটি করে দেখিয়েছেন পণ্ডিত দিশারী চক্রবর্তী। তিনি একাধারে সন্তুর বাদক, সঙ্গীত পরিচালক এবং প্রশিক্ষক। প্রায় ২৮ বছর ধরে বিভিন্ন যন্ত্রসঙ্গীতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি তিনি সাউন্ড ডিজাইন, মিউজিক কম্পোজিং ইন ফিল্ম, অডিও রেকর্ডিং অ্যান্ড এডিটিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গত ২৫ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত শাস্ত্রীয় যন্ত্রসঙ্গীতের ওপর প্রশিক্ষণ কর্মশালার মুখ্য প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন তিনি। ৭ দিনের কর্মশালা শেষে ২ ডিসেম্বর শিক্ষার্থীদের নিয়ে ৩টি ভাগে অর্কেষ্ট্রা পরিবেশন করান পণ্ডিত দিশারী চক্রবর্তী। এসময় উপস্থিত ছিলেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক জনাব লিয়াকত আলী লাকী, সঙ্গীত ও নৃত্যকলা বিভাগের পরিচালক জনাব কাজী আফতাব উদ্দিন হাবলু ও সঙ্গীত পরিচালক চন্দন দত্ত। অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা দেখে মুগ্ধ হন উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা। 
শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী মা বিদুষী অনন্যা চক্রবর্তীর কাছে সংগীতের ওপর প্রথম হাতেখড়ি নেন তিনি। মাত্র চার বছর বয়সে বেছে নিয়েছিলেন নিজের পছন্দের বাদ্যযন্ত্র কাশ্মীরি শততন্ত্রী বীণা সন্তুর। আর ৬ বছর বয়সে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের বাড়িতে ওস্তাদ ধানেশ খাঁ-এর কাছে যন্ত্রসংগীতে মাইহার ঘরানার ধ্রুপদী তালিম শুরু হয়। একটানা ৩০ বছর গুরুগৃহে থেকে কঠোর সাধনার মাধ্যমে সাফল্যের সাথে তার তালিম শেষ করেন। তিনি শুধু সন্তুরের ওপর তালিম নিয়ে থেমে থাকেননি, পাশাপাশি বিভিন্ন যন্ত্র এবং বিষয়ের ওপর শিক্ষা লাভ করেন।

মাত্র ৯ বছর বয়সে প্রথম পাবলিক প্রোগ্রামে সন্তুর বাজিয়ে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন পণ্ডিত দিশারী চক্রবর্তী। কর্মজীবনেও প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট স্কলারশিপ পেয়েছেন (১৯৯২-২০০১), ওস্তাদ আলী আকবর খান (ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট মিউজিক একাডেমী পুরস্কার- ১৯৯৯), সিসিআরটি অ্যাওয়ার্ড অব স্কলারশিপ (মিনিস্ট্রি অব ট্যুরিজম, গভ. অব ইন্ডিয়া-২০০১), সার্টিফিকেট বাই পদ্মভূষণ অন্যপূর্না দেবী (দ্যা টাইটেল অব সুর ভারতী-২০০৪), সার্টিফিকেট বাই (দ্যা টাইটেল অব সঙ্গীত নন্দন-২০২১) পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি মিউজিক ডিরেক্টরের পাশাপাশি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এ পর্যন্ত ১৪টি এবং মিউজিক কম্পোজার হিসেবে ৮টি পুরস্কার পেয়েছেন। এ পর্যন্ত ১০০টিরও অধিক থিয়েটারে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করেছেন তিনি। তার মধ্যে পুরস্কৃত হয়েছে ৩০টিরও অধিক।

এফকে