কণ্ঠ দিয়ে মন জয় করেছিলেন বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, পাঞ্জাবীসহ বেশ কয়েকটি ভাষার জনগোষ্ঠীর। যার গান এখনও শোনা যায় ঘরের গৃহবধু থেকে সংগীত প্রিয় যে কারো কণ্ঠে। তিনি শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের সন্তান গীতা রায় চৌধুরী। ভারতীয় বিখ্যাত সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পরিচালক হনুমান প্রসাদ ও বিভিন্ন গুণী মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে কালের ইতিহাসে স্বরণীয় বরণীয় সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রায় শত বছর ধরে বেঁচে আছেন এই শিল্পী। ভালোবেসে বিয়ে করে স্বামীর পদবীর সাথে মিলিয়ে গীতা রায় চৌধুরী থেকে গীতা দত্ত নামে পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। এখনও তার গান সবার মুখে মুখে থাকলেও জন্মস্থানের অধিকাংশ মানুষই চিনেন না গীতা দত্তকে।

সম্প্রতি শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে গিয়ে জানা যায়, বহু বছর আগে টেংরা গ্রামে অবস্থিত গীতা দত্তের বাড়ি জয়ন্তী নদীতে ভেঙে নিয়ে গেছে। সেই নদীতে এখন আবার চর জেগেছে। স্থানীয়রা বলছেন, সরকার চাইলে চিহ্নিত করতে পারে প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী গীতা দত্তের বাড়ির অবস্থান।

স্থানীয় লোকজ গবেষক ও ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন মাদারীপুর মহাকুমার ইদিলপুরের বর্তমান শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার গোসাইরহাট ইউনিয়নের টেংরা গ্রামে দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ রায় চৌধুরী ও অমিয়া দেবীর কোলে পঞ্চম সন্তান হিসেবে ১৯৩০ সালের ২৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন গীতা রায় চৌধুরী। দশ ভাই বোনের মধ্যে পঞ্চম সন্তান গীতা দত্ত ছিলেন ইদিলুপর স্কুলের শিক্ষার্থী। তার বাবা দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ইদিলপুরের জমিদার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভিটেমাটি ছেড়ে দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ সপরিবারে প্রথমে কলকতায়, পরে মুম্বাই শহরে পাড়ি জমান। জমিদারিসহ পূর্ব পুরুষের ভিটাবাড়ি হাত ছাড়া হওয়ার পর বাবা মায়ের সাথে মুম্বাই শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় থাকা শুরু করেন গীতা। জমিদার বাবার আদরের মেয়ে গীতা দত্তকে ১২ বছর বয়সেই জীবিকার তাগিদে করতে হয়েছিল টিউশনি। শিক্ষার্থী পড়ানোর জন্য মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো তাকে। সংগ্রামী এই জীবনই একসময় তাকে বিখ্যাত সংগীত শিল্পীতে পরিণত করেছে।

লোকজ গবেষক শ্যামসুন্দর দেবনাথ ঢাকা পোস্টকে জানান, বোম্বে শহরের একটি বাড়ির তিন তলায় থাকতেন কিশোরী গীতা দত্ত। বাড়ির নিচ তলায় ছিল গানের স্কুল। স্কুলে তৎকালীন হিন্দি ছবির সংগীত পরিচালক হনুমান প্রসাদ এসেছিলেন অতিথি হিসেবে। নিচ তলায় বসে হনুমান প্রসাদ তিনতলা থেকে ভেসে আসা কিশোরী গীতা দত্তের সুরেলা কণ্ঠের রিহার্সেল শুনছিলেন। হনুমান প্রসাদ মহাকালের অমর শিল্পীকে চিনতে ভুল করলেন না। তার নির্মিত পরবর্তী ছবি ‘ভক্ত প্রহ্লাদ’-এ (১৯৪৬) কিশোরী গীতা দত্তকে দুই লাইন গান গাওয়ার সুযোগ করে দেন। ভক্ত প্রহ্লাদ ছবিতে দুই লাইন গানে কণ্ঠ দিয়ে যাত্রা শুরু করে গীতা দত্ত পরবর্তীতে হয়েছিলেন ‘দ্য নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’।

গীতা দত্ত ১৯৪৭ সালে মেট্রিক পাস করেন। ঐ বছরই নেপথ্য গায়িকা হিসেবে ‘দো ভাই’ ছবির হিন্দি গানে প্রখ্যাত সুরকার শচীনদেব বর্মণ গীতা রায়ের কণ্ঠে জাদু ফুটিয়ে ছবির জগতে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসেবে জায়গা করে দেন। শচীনদেব বর্মণ গীতা দত্তের বাঙালি টানকে শৈল্পীক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ‘দেবদাস’ (১৯৫৫) ও ‘পেয়াসা’ (১৯৫৭) ছবিতে।

গীতা দত্ত ও লতা মঙ্গেশকার ১৯৫০ এর দশকে দুই প্রধান প্লে-ব্যাক গায়িকা ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে হিন্দি গান ছাড়াও গীতা দত্ত গুজরাটি ভাষার বিখ্যাত সুরকার অবিনাশ ব্যাসের সুরে গান গেয়েছেন। ১৯৬০ এর দশকে বাংলা ছবি ও সংগীতের স্বর্ণযুগ চলছিল। এসময় সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য বাংলা গানে কণ্ঠ দেন গীতা। বাংলা গানে মায়াবী কণ্ঠের জাদুতে সুরাইয়া পরবর্তী সংগীত শিল্পীদের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করেছিলেন তিনি। নেপালী চলচ্চিত্র ‘মৈতিঘর’ এ নেপথ্য শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করা গীতা দত্ত। হিন্দিতে প্রায় ১২ শতাধিক গানে কণ্ঠ দেওয়ার পাশাপাশি বাংলা, মারাঠি, গুজরাটি, মৈথিলি, পাঞ্জাবি ভাষায় অনেক গান গেয়েছেন। যার প্রায় সব গানই কালজয়ী।

গীতা দত্তের উল্লেখ্যযোগ্য বাংলা গানের মধ্যে অন্যতম ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়’, ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’, ‘ওগো সুন্দর জানো নাকি’, ‘এই মায়াবি তিথি’। হিন্দি গানের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ‘মেরা সুন্দর সাপনা বীত গয়া’, ‘ও সাপনেবালি রাত’, ‘আন মিলো আন মিলো’, ‘আজ সাজন মুঝে অঙ্গ লাগা লে’, ‘তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির’সহ ইত্যাদি।

চলচ্চিত্রে গান রেকর্ড করতে গিয়ে গীতা রায় চৌধুরী হৃদয়ঘটিত প্রেমের সম্পের্কে জড়িয়ে পড়েন তৎকালীন নায়ক ও উঠতি পরিচালক গুরু দত্তের সাথে। ১৯৫৩ সালের ২৩ শে মে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও তাদের দাম্পত্য জীবন দীর্ঘ হয়নি। ১৯৫৭ সালে ‘গৌরী’ ছবি পরিচালনা করতে গিয়ে ওয়াহিদা রেহমানের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন গুরু দত্ত। স্বামী গুরু দত্তের পরিচালিত গৌরী ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করতে গিয়ে গীতা জানতে পারেন গুরু দত্ত ও ওয়াহিদার পরকীয়া প্রেমের সম্পর্কের কথা। এই সম্পর্ক মানতে না পেরে ২৭ বছর বয়সী কণ্ঠশিল্পী গীতা দত্ত ডুবে যান মদ্যপানে। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়া প্লে-ব্যাক সংগীত তারকার জীবনে নেমে আসে আবার আর্থিক সংকট। কিন্তু ততদিনে পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। ১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর গুরু দত্ত আত্মহত্যা করলে গীতা দত্তের আর্থিক সমস্যা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। সংগীতের বোদ্ধা মহল এখনও গীতাকে নিয়ে বলেন, লতাকণ্ঠী, আশাকণ্ঠী হওয়া যায় কিন্তু গীতাকণ্ঠী হওয়া যায় না।

লাস্যময়ী, কোকিলকণ্ঠী গীতা দত্ত ৪০ বছর বয়সে ১৯৭২ সালের ২০ জুলাই তিন সন্তান তরুণ কুমার দত্ত, অরুণ কুমার দত্ত ও নীনা দত্তসহ অগণিত শ্রোতা ভক্ত ও হিতাকাঙ্খি রেখে লিভার সিরোসিসে আক্তান্ত হয়ে মুম্বাইয়ের হরকিষণ দাস হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। বিখ্যাত এই সংগীত শিল্পীর স্বীকৃতি স্বরূপ ভারত সরকার ২০১৩ সালে ও ২০১৫ সালে একটি করে ডাকটিকেট প্রকাশ করেছিল।

গীতা দত্তের ছোট ভাই মিলন রায় চৌধুরীর বরাতে কবি ও লোকজ গবেষক শ্যামসুন্দর দেবনাথ বলেন, গায়ের রঙ লাল টুকটুকে হওয়ায় গীতা দত্তকে মিলন রায় রাঙাদি ডাকতেন। গলা বাঁচিয়ে চলতেন গীতা দত্ত। টক, আইসক্রিম খেতেন না। বরাবরই আশ্চর্য সব ক্ষমতা ছিল তার। 

গুরু দত্তের ছোট বোন ললিতা লাজমির কথায়, গীতার বয়স যখন আঠারো তখন তিনি বিরাট স্টার। ১৮ বছর বয়সেই তিনি নানা ভাষায় প্রায় নয় শতাধিক গান গেয়ে ফেলেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় অধিকাংশ ভাষায় গান গাওয়া এই শিল্পীর আদিনিবাস ও জন্মস্থান শরীয়তপুরে হলেও এখানকার বোদ্ধামহল থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষই চিনেন না তাকে। কিন্তু তার গান সবারই প্রিয়। 

গোসাইরহাটের সরকারি শামসুর রহমান কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন সহাকারী অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গীতা দত্তসহ সারাদেশের সংস্কৃতিমনা মানুষদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় আমরা আমাদের বিশ্বজয় করা কৃতী সন্তানদের চিনি না। গীতা দত্তের মতো হাজারো গুণী মানুষকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কেউ না চেনায় আমরা আমাদের শিকড়কে হারিয়ে ফেলতে বসেছি। কোনো জাতি তার শিকড়কে হারিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। সরকারের দায়িত্বে যারাই আসুক, তাদের উচিত বাঙালির শিকড়কে নিজ দেশসহ বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়া। তবেই গীতা দত্তদের কদর করতে জানবে জাতি।

এনএইচ